
নিউজ ডেস্ক : জুলাই সনদের আইনি বাধ্যবাধকতা নিশ্চিতে গণভোট অথবা বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ জারির পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে জুলাই সনদের আইনি কাঠামো এবং বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা বিষয়ে এ মতামত আসে।
গতকাল রোববার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে দুই ঘণ্টাব্যাপী রুদ্ধদ্বার এ বৈঠকে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এবং অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামানও ছিলেন। বিশেষজ্ঞ হিসেবে ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম এ মতিন, বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শরীফ ভূঁইয়া ও ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিক।
গত ১০ আগস্টের বৈঠকে বিশেষজ্ঞরা জুলাই সনদ বাস্তবায়নে চারটি বিকল্প দিয়েছিলেন। এগুলো হলো– অধ্যাদেশ জারি, সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের মতামত গ্রহণ, গণভোট এবং গণপরিষদ গঠন।
ঐকমত্য কমিশন সনদের পূর্ণাঙ্গ খসড়া থেকে অধ্যাদেশ বাদ দিয়েছে। তবে বাকি বিকল্পগুলোও উল্লেখ করা হয়নি। খসড়ায় আট দফায় অঙ্গীকারের শেষটিতে বলা হয়েছে, বাস্তবায়নযোগ্য সংস্কারগুলো কালক্ষেপণ ছাড়াই নির্বাচনের আগে বাস্তবায়ন করবে সরকার।
গতকালের বৈঠকে ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মতামত গ্রহণের বিকল্প নিয়ে আলোচনা হয়নি। বাদ যায় অধ্যাদেশ জারি করে সংস্কার বাস্তবায়নের পরামর্শ। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ৯৩(২) অনুচ্ছেদে অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংবিধানের কোনো বিধান পরিবর্তন বা রহিতে বাধা রয়েছে। বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, গণভোট এবং সাংবিধানিক আদেশ ছাড়াও গণপরিষদ নিয়ে আলোচনা হয়। তবে তৃতীয় বিকল্পটি গ্রহণ করা হয়নি।
সনদের খসড়া মতামতে বিএনপি জানিয়েছে, যেসব সংস্কার কার্যকরে সংবিধান সংশোধন করতে হবে, সেগুলো আগামী সংসদে বাস্তবায়ন করা হবে। এর বিরোধী জামায়াতে ইসলামী জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোট চেয়েছে। এনসিপি চায় গণপরিষদের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কার।
খসড়ায় বলা হয়েছে, সংবিধান ও আইনের ওপর প্রাধান্য পাবে সনদ। কোনো আদালতে সনদ নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না। এ দুই অঙ্গীকারে বিএনপি রাজি না হলেও জামায়াত একমত। এনসিপি সনদের আইনি ভিত্তি চাইলেও সংবিধানের ওপর প্রাধান্য চায় না।
রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্য না হওয়ায় প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন কমিশন সনদ বাস্তবায়নের নানা বিকল্প পথ খুঁজছে। বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সনদ বাস্তবায়নে ১৪২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী গণভোট এবং সাংবিধানিক আদেশ জারি করা যেতে পারে। তবে পরবর্তী সংসদ চাইলে তা বাতিল করতে পারবে। আদালতে প্রশ্ন তোলারও সুযোগ থাকবে।
বৈঠকে উপস্থিত একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, এই দুই বিকল্প ছাড়া আর পথ আপাতত নেই। রাজনৈতিক কারণে হলেও গণভোটে জুলাই সনদ অনুমোদিত হলে তা কেউ বাতিল করতে পারবে না। জুলাই অভ্যুত্থানের অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ জারি করা যেতে পারে।
বৈঠকে উপস্থিত আরেক বিশেষজ্ঞ বলেন, গণভোটে গেলে জুলাই সনদ বিষয়ে জনগণের ক্ষমতা প্রয়োগের বিষয় থাকবে। গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন একসঙ্গে হতে পারে। সে ক্ষেত্রে ব্যালটে নির্বাচনী প্রতীকের পাশাপাশি জুলাই সনদের বিষয়টি থাকতে পারে।
রাজনৈতিক মতভিন্নতার কারণে গণভোট আয়োজন সম্ভব হবে কিনা– এ নিয়েও আলোচনা হয় বৈঠকে। শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। বৈঠকে আলোচনা হয়, রাজনৈতিক ঐকমত্য হলে সনদ যে কোনো উপায়ে বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বিভিন্ন বিকল্প সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে। সনদের আইনগত বাধ্যবাধকতা ও বাস্তবায়নের পথ খোঁজা হচ্ছে। কোন পথ গ্রহণ করা হবে, এ সিদ্ধান্ত হয়নি।
জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদসহ অধিকাংশ দল জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি চায়। দলগুলোর দাবি, সনদের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। বিএনপি ও সমমনা দলগুলো এর বিরুদ্ধে। কমিশন সূত্র জানিয়েছে, তারা মাঝামাঝি একটি পথ খুঁজছে, যা সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।
খসড়া সনদের অঙ্গীকারে বলা হয়েছে, বাস্তবায়নযোগ্য সংস্কার কোনগুলো– এ নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর। প্রথম সংলাপে রাজনৈতিক দলগুলোর ৬২টি সংস্কার প্রস্তাবে ঐকমত্য হয়েছে। দ্বিতীয় দফার সংলাপে ২২ সংস্কারের কমিশন সিদ্ধান্ত দিলেও রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য হয়েছে ১১টিতে। বাকিগুলোর ৯টিতে বিএনপির নোট অব ডিসেন্ট (আপত্তি) রয়েছে। তারা জানিয়েছে, ক্ষমতায় গেলে এগুলো বাস্তবায়ন করবে না। জামায়াত নির্বাচনের আগেই ৮৪ সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন চায়।
কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, সনদ বাস্তবায়নের উপায় হিসেবে গণভোটসহ বিভিন্ন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সনদ বাস্তবায়নে আইনি বাধ্যবাধকতা কীভাবে তৈরি করা যায়, এ নিয়েও আলোচনা হয়েছে। কোন কোন সংস্কার নির্বাচনের আগে বাস্তবায়নযোগ্য– এ তালিকা করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বৈঠকে আইন উপদেষ্টা ও অ্যাটর্নি জেনারেলের উপস্থিতি সম্পর্কে আলী রীয়াজ বলেন, সনদ বাস্তবায়নে সরকার কী করতে পারে, তা তারা বলেছেন।
কমিশন সূত্রে জানা গেছে, বাস্তবায়নযোগ্য সংস্কারগুলো দ্রুত কার্যকর করতে চায় সরকার। এগুলো চিহ্নিত করতে আইন মন্ত্রণালয় পরামর্শক নিয়োগ করেছে বলে কমিশনকে জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা। তবে এ বিষয়ে ড. আসিফ নজরুলের বক্তব্য জানতে পারেনি ।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তৃতীয় ধাপের সংলাপের আগে সনদ বাস্তবায়নের একাধিক বিকল্প পদ্ধতি ঠিক করতে চায় কমিশন। তবে কবে থেকে সংলাপ শুরু হবে, তা ঠিক হয়নি।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কমিশন সদস্য সফর রাজ হোসেন, বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান ও ড. মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।
মন্তব্য (০)