
নিউজ ডেস্কঃ নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশ যখন নতুন এক যুগে প্রবেশ করছে, তখন বিশ্ব তাকিয়ে আছে আশার দৃষ্টিতে। ছাত্র আন্দোলন ও রাজনৈতিক টালমাটালের মধ্য দিয়ে উঠে আসা এই নেতৃত্ব দক্ষিণ এশিয়ায় গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের বিজয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছে। তবে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পুনর্গঠনের পাশাপাশি এখন সময় এসেছে পাশের বিপর্যস্ত রাষ্ট্র মিয়ানমারের দিকে মনোযোগ দেওয়ার। ব্যাংকক পোস্টে মানবাধিকারকর্মী ও অনুসন্ধানী সাংবাদিক অ্যালান ক্লেমেন্টস মতামতে এমনটাই জানিয়েছেন।
নোবেলজয়ী অং সান সু চির নেতৃত্বে আশার আলো দেখানো মিয়ানমার ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে নেমে গেছে চরম বিশৃঙ্খলায়। দেশটি এখন গণহত্যার দ্বারপ্রান্তে। হাজার হাজার মানুষকে বন্দি, নির্যাতিত ও হত্যা করা হচ্ছে একটি নির্মম সামরিক শাসনের হাতে। বন্দিদের মধ্যে রয়েছেন সু চিও, যিনি বর্তমানে একা একটি অজানা কারাগারে বন্দি আছেন।
রোহিঙ্গা সংকট সারা বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে ঠিকই, কিন্তু এটি মিয়ানমারে দশকের পর দশক ধরে চলা সামরিক নিপীড়নের কেবল একটি অধ্যায়। দেশটির আরও বহু জাতিগোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে একই নিপীড়নের শিকার হয়ে আসছে।
২০১৭ সালে আরাকান আর্মির হামলার পর সামরিক বাহিনীর নির্মম অভিযান শুরু হলে সু চির শান্তি ও ন্যায়বিচারের প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত হয়। তিনি রাখাইন সংকট সমাধানে কফি আনান কমিশন গঠন করে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, তবে পরিস্থিতি দ্রুত খারাপের দিকে গড়ায়।
বাংলাদেশের নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অধ্যাপক ইউনূসের রয়েছে এক অনন্য অবস্থান। মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সরাসরি রোহিঙ্গা সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত। বাংলাদেশের নেতৃত্ব শুধু দেশের ভেতরে নয়, আন্তর্জাতিক পরিসরেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে, বিশেষ করে মিয়ানমারের রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে।
২০২৪ সালের ১৬ আগস্ট জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বাংলাদেশের নতুন সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, সংখ্যালঘুসহ সকল নাগরিকের সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর কল্যাণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। তার বার্তা অত্যন্ত সময়োপযোগী, কারণ রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের একমাত্র উপায় হলো অং সান সু চি ও নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের অবিলম্বে মুক্তি।
আজকের বিশ্ব এক ‘সত্য সংকট’-এর মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যেখানে ভুল তথ্য ও অপপ্রচারের প্রভাবে সত্য চাপা পড়ছে। অনেকেই সু চিকে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে আঁতাতের অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন কিন্তু প্রমাণগুলো সেই অভিযোগ খণ্ডন করে। আমার এবং সহলেখক ফারগাস হারলোর লেখা চার খণ্ডের গ্রন্থে সু চির ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্রের প্রতি অটল প্রতিশ্রুতির বহু প্রমাণ রয়েছে।
রাশিয়া ও চীনের মতো শক্তিধর দেশগুলোর সরবরাহকৃত অস্ত্রে মিয়ানমারের সংঘাত আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। এই প্রেক্ষাপটে অধ্যাপক ইউনূসের প্রতি আমাদের আহ্বান থাকবে আপনার নেতৃত্ব ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে।
আমরা ‘অশোক শান্তি চুক্তি’ নামক একটি উদ্যোগ প্রস্তাব করছি। যার মূল দাবি মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক নেতাদের মুক্তি ও সহিংসতা অবসান। এটি হতে পারে মিয়ানমারের দ্বিতীয় স্বাধীনতার সূচনা, যেখানে সত্য, সম্মান ও মানবিক বিবেক হবে বিজয়ী।
সু চির আইনজীবী কো নিই-এর হত্যাকাণ্ড, যিনি নাতিকে কোলে নিয়ে থাকা অবস্থায় প্রকাশ্যে গুলিবিদ্ধ হন। যা এই সংকটের গভীরতা তুলে ধরে। এটি শুধু একটি ব্যক্তির উপর হামলা নয়, বরং ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা ও আইনের শাসনের উপর সন্ত্রাসী আঘাত।
অধ্যাপক ইউনূসের কণ্ঠস্বর, প্রভাব ও নৈতিক অবস্থান মিয়ানমারে ঘটে চলা অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া জোরালো করতে পারে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বিজয় একটি প্রেরণা হতে পারে, যেখানে সাহস ও বিবেক একত্র হয়ে পরিবর্তনের পথে এগিয়ে যায়।
বাংলাদেশের মানুষ যেমন স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার চায়, তেমনিভাবে মিয়ানমারের মানুষও চায় গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তন। অং সান সু চি এবং হাজার হাজার রাজবন্দির মুক্তি শুধুমাত্র মিয়ানমারের ভবিষ্যতের জন্য নয়, এটি আজকের পৃথিবীর জন্য একটি নৈতিক দায়িত্ব।
বাংলাদেশের এই উত্তরণের পথে দেশটি যদি মিয়ানমারের জন্যও ন্যায় ও স্বাধীনতার আওয়াজ তোলে, তবে বিশ্ব দেখবে একটি নতুন ইতিহাসের সূচনা। এখনই সময় সাহসী নেতৃত্ব দেখানোর। এমন নেতৃত্ব যা মানবতার সাধারণ মূল্যবোধে আমাদের সবাইকে একত্র করে।
মন্তব্য (০)