নিউজ ডেস্কঃ জীবদ্দশায় জনসমক্ষে মাত্র দুবার কেঁদেছিলেন তিনি। প্রথমবার, চট্টগ্রাম থেকে শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মরদেহ যখন ঢাকায় আনা হয়েছিল। দ্বিতীয়বার, সেনানিবাসের বাড়ি থেকে উচ্ছেদের দিন। সংবাদমাধ্যমের সামনে দাঁড়িয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে দেশবাসী দেখেছিল এক দৃঢ় মানবীর নিঃশব্দ যন্ত্রণা। এরপর আর কখনো তাকে কাঁদতে দেখেনি কেউ। জেল-জুলুম, নির্যাতন, বন্দিত্ব, অসংখ্য অপমান আর শারীরিক যন্ত্রণার মাঝেও তিনি ছিলেন অবিচল। সেই আপসহীন নেত্রী, আধিপত্যবিরোধী সংগ্রামের প্রতীক, তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অবশেষে জীবনের পরম সত্যের কাছে নিজেকে সঁপে দিলেন। এবার আর তিনি নিজে কাঁদলেন না; কোটি মানুষকে কাঁদিয়ে বিজয়ের মাস ডিসেম্বরেই পাড়ি জমালেন পরপারে। শায়িত হলেন প্রিয় স্বামী শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পাশে, চিরঘুমে।
বুধবার (৩১ ডিসেম্বর) বিকেল ৩টা ৪ মিনিটে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় অনুষ্ঠিত হয় খালেদা জিয়ার জানাজা। জানাজায় ইমামতি করেন জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব মুফতি আবদুল মালেক। জানাজায় উপস্থিত ছিলেন তার বড় ছেলে ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ পরিবারের সদস্য, বিএনপির শীর্ষ নেতারা, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ এবং বিদেশি অতিথিরা। পুরো আয়োজন পরিচালনা করেন বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান।
আরও উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, প্রধান বিচারপতি, তিন বাহিনীর প্রধান, জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান, সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। দেশের ইতিহাসে এটাই সর্ববৃহৎ জানাজা বলে ধারণা করা হচ্ছে।
জানাজা শেষে বিকেল ৪টা ৪০ মিনিটের দিকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেরেবাংলা নগরের জিয়া উদ্যানে তাকে দাফন করা হয়। শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পাশেই চিরনিদ্রায় শায়িত হন তিনি। দাফনকালে পরিবারের সদস্য, সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, বিদেশি অতিথি ও বিএনপির মনোনীত প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে, গুলশানের বাসভবন ফিরোজা থেকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় খালেদা জিয়ার মরদেহ আনা হয় মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে। সেখানে সকাল থেকেই নেমে আসে শোকার্ত মানুষের ঢল। ভোর থেকেই লাখো মানুষ অবস্থান নেয় জাতীয় সংসদ ভবনসংলগ্ন এলাকায়। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জনস্রোত রূপ নেয় জনসমুদ্রে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ট্রাক, বাস, ট্রেনযোগে ছুটে আসেন সাধারণ মানুষ ও নেতাকর্মীরা। কারও হাতে কালো ব্যাজ, কারও চোখে অশ্রু—সবার বুকে একটাই বেদনা, একজন আপসহীন দেশনেত্রীকে হারানোর শোক।
মানুষের চাপ সামাল দিতে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজার প্রবেশপথ খুলে দেয়া হয়। দক্ষিণ প্লাজার দুটি বড় মাঠ জানাজার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হলে লাখো মানুষ সেখানে অবস্থান নেন। জানাজা নির্বিঘ্ন করতে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউসহ পুরো এলাকায় মোতায়েন করা হয় ২৭ প্লাটুন বিজিবি। পুলিশ, এপিবিএন, র্যাব, বিজিবি ও সেনাবাহিনীসহ ১০ হাজারের বেশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য দায়িত্ব পালন করেন। গোয়েন্দা নজরদারিও ছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ে।
খালেদা জিয়ার শেষ বিদায়ে অংশ নিতে ঢাকায় আসেন পাকিস্তানের স্পিকার, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ভুটান ও মালদ্বীপের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের প্রতিনিধি, শ্রীলঙ্কা ও নেপাল সরকারের প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন দেশের মন্ত্রী ও বিশেষ দূতরা। ইতিহাসের এক শোকাবহ জনসমাবেশের সাক্ষী হয় রাজধানী।
প্রায় ৮০ বছর বয়সী খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস, লিভার সিরোসিস ও কিডনির জটিলতায় ভুগছিলেন। গত ২৩ নভেম্বর গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই ৩৭ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) সকালে ইন্তেকাল করেন তিনি।
দীর্ঘ বন্দিদশায় শরীর ও মন ভেঙে পড়েছিল এই আপসহীন নেত্রীর। একসময় ন্যূনতম চিকিৎসার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হতে হয়েছিল তাকে। জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচারের পতনের পর তিনি বন্দিত্ব থেকে মুক্ত হন। চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান। সেখানে শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়, বড় ছেলে তারেক রহমানের সঙ্গে ঈদ উদ্যাপন করেন। ৬ মে দেশে ফেরার দিন বিমানবন্দর থেকে গুলশান পর্যন্ত তার প্রত্যাবর্তন ঘিরে নেমে এসেছিল জনতার ঢল। কিন্তু বয়স ও জটিল রোগ বারবার তাকে কাবু করে ফেলছিল। শেষ পর্যন্ত ২৩ নভেম্বর হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ৩৭ দিনের লড়াই শেষে তিনি মেনে নেন পরম সত্য।
তাকে বাঁচিয়ে রাখতে পরিবার, দল ও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো প্রচেষ্টার ঘাটতি ছিল না। দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে চলছিল চিকিৎসা, পরিবারের সদস্যরা দিনরাত প্রার্থনায় ছিলেন, সমর্থকেরা হাসপাতালের বাইরে অশ্রুসিক্ত চোখে অপেক্ষা করেছেন। মসজিদ-মন্দির-গির্জায় তার সুস্থতার জন্য দোয়া হয়েছে। তবু মৃত্যুকে থামানো যায়নি। হাসপাতালের শয্যায় হয়তো তিনিও লড়াই করছিলেন শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত—যে লড়াইয়ে মানুষের হারই শেষ সত্য।
খালেদা জিয়ার মৃত্যুসংবাদে স্তব্ধ হয়ে পড়ে দেশ। শোক জানায় বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। দেশ-বিদেশের রাষ্ট্রনায়ক ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা শোকবার্তা পাঠান। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে ভাষণে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেন এবং জানাজা ও দাফনের দিন সাধারণ ছুটি দেন।
মায়ের মৃত্যুতে তারেক রহমান বলেন, ‘আমার কাছে খালেদা জিয়া একজন মমতাময়ী মা, যিনি নিজের সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছেন দেশ ও মানুষের জন্য।’
রাজনীতির দীর্ঘ পথে খালেদা জিয়ার জীবন ছিল উত্থান-পতনের, বন্দিত্বের, অপমানের ও সংগ্রামের এক দীর্ঘ ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে বন্দিত্ব, স্বামী হারানোর শোক, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, কারাবাস, নির্বাসন—সবকিছুই তিনি বহন করেছেন নীরব দৃঢ়তায়। ব্যক্তিগত জীবনের অসহনীয় ক্ষতি আর রাজনৈতিক জীবনের অজস্র ঝড়ঝাপটার মাঝেও তিনি ভাঙেননি। তার নীরব প্রতিরোধ ছিল ধৈর্যের, মর্যাদার ও আত্মবিশ্বাসের প্রতীক।
১৯৪৬ সালে জলপাইগুড়িতে জন্ম নেয়া খালেদা জিয়া, যার ডাকনাম ছিল ‘পুতুল’; কৈশোরেই জীবনের কঠিন পথে পা রাখেন। মাত্র ১৫ বছর বয়সে বিয়ে হয় তরুণ সেনা কর্মকর্তা জিয়াউর রহমানের সঙ্গে। সেখান থেকেই শুরু হয় এক অনন্য জীবনযাত্রা; যার পরিণতি তিনবারের প্রধানমন্ত্রীত্ব, আবার দীর্ঘ বন্দিত্ব ও সংগ্রাম।
১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমান শহিদ হওয়ার পর লাখো মানুষের দাবিতে বিএনপির নেতৃত্বে আসেন তিনি। আটপৌরে গৃহবধূ থেকে হয়ে ওঠেন দেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তির নেত্রী। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। এরপর আরও দুই দফা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। ২৩টি আসনে নির্বাচন করে কখনো পরাজিত হননি।
সমালোচনা ও বিতর্ক তার পথেও এসেছে। শাসনামলে দুর্নীতি, নানা রাজনৈতিক সংকট ও বিতর্ক তাকে তাড়া করেছে। তবু সমর্থকদের চোখে তিনি ছিলেন আপসহীন নেত্রী, জাতীয়তাবাদের প্রতীক।
আজ তিনি নেই। কিন্তু তার জীবনগাথা শুধু একজন রাজনীতিকের ইতিহাস নয়; এটি অগ্নিদগ্ধ সময়ের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক দৃঢ়চেতা নারীর সংগ্রামের কবিতা। তিনি আর ফিরবেন না। তবে ধানের শীষে, মানুষের স্মৃতিতে, জাতীয়তাবাদের প্রতীকে তিনি বেঁচে থাকবেন চিরকাল।
মন্তব্য (০)