রংপুর ব্যুরোঃ রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নের উত্তর রহিমাপুর গ্রাম এখনো শোকে নিস্তব্ধ। শান্ত, নিরিবিলি এই গ্রামটি অন্ধকারে কেঁপে উঠেছে এক নৃশংস হত্যাকাণ্ডে। প্রবীণ বীর মুক্তিযোদ্ধা যোগেশ চন্দ্র রায় (৭৫) এবং তাঁর স্ত্রী সুর্বণা রায় (৬৫)–কে গত দুই রাতের মধ্যে নিজ বাড়িতেই হত্যা করেছে অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা।
স্থানীয়রা রবিবার (৭ ডিসেম্বর )সকালে ডাকাডাকি করলে সাড়া না পেয়ে সন্দেহ হয়। পরে ঘরের দরজা ভেঙে ঢুকে তারা দেখেন—মেঝেতে পড়ে আছে দম্পতির রক্তাক্ত মরদেহ; চারদিকে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রক্তের দাগ, ভাঙচুর করা আসবাবপত্র—সব মিলিয়ে নির্মম হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহ দৃশ্য।
খবর পেয়ে তারাগঞ্জ থানা পুলিশ এবং জেলা পুলিশের একটি বিশেষ টিম দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে আলামত সংগ্রহ করে। পুলিশের প্রাথমিক ধারণা—চাইনিজ কুড়াল বা অনুরূপ ধারালো অস্ত্র দিয়ে মাথায় আঘাত করে দু’জনকে হত্যা করা হয়েছে। ঘরের ভেতরকার নৃশংসতার চিত্র থেকে অনুমান করা হচ্ছে—হত্যা পূর্বপরিকল্পিত ছিল এবং ঘাতক বা ঘাতকরা ঘরে ঢুকেছিল রাত ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে রংপুরের পুলিশ সুপার মো. মারুফাত হুসাইন বলেন আমরা গুরুত্বপূর্ণ আলামত সংগ্রহ করেছি। ফরেনসিক টিম ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে। ধারণা করছি রাত ১১টা-১২টার মধ্যে এই হত্যাটি সংঘটিত হয়েছে। খুব দ্রুতই এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করা হবে।”
তিনি আরও জানান, হত্যাকারীরা যে-ই হোক, যতই পরিকল্পিত হোক আইনের হাত থেকে কেউই রক্ষা পাবে না। প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণ, মোবাইল টাওয়ারের তথ্য, আশপাশের লোকজনের জবানবন্দি—সব দিক থেকেই তদন্ত এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
গ্রামে শোক, আতঙ্ক, ক্ষোভ
হত্যাকাণ্ডের খবর ছড়িয়ে পড়তেই গ্রামজুড়ে নেমে আসে শোকের ছায়া। মানুষ বিশ্বাস করতে পারছে না—এমন নিরীহ, সজ্জন এক দম্পতিকে কে হত্যা করতে পারে।
একজন প্রতিবেশী কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন এমন মানুষকে কে হত্যা করতে পারে-বুঝতেই পারছি না। খুব পরিকল্পিত মনে হচ্ছে।”
স্থানীয় দুলাল,সবুজ,নয়ন আরেকজন জানান একজন মুক্তিযোদ্ধাকে এভাবে হত্যা—এটা দেশের জন্যই লজ্জাজনক। আমরা দ্রুত বিচার চাই।”
মুক্তিযোদ্ধা সমাজের ক্ষোভ
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আলী হোসেন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন-আমাদের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে এভাবে হত্যা মেনে নেওয়া যায় না। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করতে হবে। না হলে কঠোর আন্দোলনে নামবো।”
তিনি জানান, যোগেশ চন্দ্র রায় ছিলেন একজন সৎ, নির্লোভ, নিভৃতচারী মানুষ। স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত সাহসিকতাপূর্ণ। অবসরের পর শিক্ষকতা জীবন শেষে তিনি গ্রামের মানুষদের সঙ্গে শান্তিতে দিন কাটাচ্ছিলেন।
দম্পতির দুই ছেলে চাকরির কারণে দীর্ঘদিন ধরে বাইরে থাকতেন। ফলে বাবা–মা প্রায়ই বাড়িতে একাই থাকতেন।
পরিবারের ঘনিষ্ঠরা জানান তাদের কারও সঙ্গে কোনোরকম বিরোধ ছিল না।ব্যক্তিগত শত্রুতা, জমি–জমার বিরোধ বা আর্থিক কোনো লেনদেন—এসব কিছুই তাদের ক্ষেত্রে খুবই অস্বাভাবিক।
তবে তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন-“সব দিকই খতিয়ে দেখা হচ্ছে। জমি, শত্রুতা, পূর্বপরিকল্পনা-কিছুই বাদ রাখা হচ্ছে না। ফরেনসিক রিপোর্ট এলে অনেকটাই পরিষ্কার হবে।
রংপুরের তারাগঞ্জ আজ শোকে আচ্ছন্ন। বীর মুক্তিযোদ্ধা যোগেশ চন্দ্র রায় ও তাঁর স্ত্রীর নির্মম হত্যাকাণ্ড গোটা অঞ্চলকে নাড়িয়ে দিয়েছে। ঘটনায় শোকের পাশাপাশি দানা বেঁধেছে ক্ষোভও।
গ্রামবাসী, মুক্তিযোদ্ধা সমাজ এবং সাধারণ মানুষ একটাই দাবি তুলছেন ঘাতকদের দ্রুত গ্রেপ্তার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।
মন্তব্য (০)