নওগাঁ প্রতিনিধি: সমাজের এমন কিছু নারী রয়েছেন যারা প্রতিনিয়তই প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে জীবন যুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। কেউ কেউ সেই যুদ্ধে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন। কেউ কেউ সমাজের আর দশজন নির্যাতিত ও অবহেলিত নারীদের প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নীরবে কাজ করে যাচ্ছেন। কেউ কেউ শত বাধা-বিপত্তিকে পায়ে দলে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন। এমন সব নারীদের সাহসিকতার অবদান এবং ভালো কাজের স্বীকৃতি ও প্রেরণা দেওয়ার লক্ষ্যে সরকার ও বিভিন্ন সংগঠন প্রতিনিয়তই কাজ করে যাচ্ছে।
বর্তমান সময়ে আমাদের সমাজে এমন অসংখ্য নারী রয়েছে যারা নিজেদের মনোবল, ইচ্ছাশক্তি এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে হয়ে উঠেছেন আত্মস্বাবলম্বী। আর এই সব নারীদের তৃণমূল পর্যায় থেকে উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত করার লক্ষে মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধিনে উপজেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর জীবন যুদ্ধে জয়ী নারীদের স্বীকৃতি প্রদানের জন্য নানা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে আসছে। নওগাঁর রাণীনগরে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্য মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে চলতি বছর “অদম্য নারী পুরস্কার” কার্যক্রমের আওতায় আন্তর্জাতিক নারী প্রতিরোধ পক্ষ ও বেগম রোকেয়া দিবসে উপজেলার পাঁচ অদম্য নারীকে পুরস্কার ও সংবর্ধনা প্রদান করা হয়েছে।
উপজেলার পাঁচ অদম্য নারীরা হলেন অর্থনৈতিক ভাবে সাফল্য অর্জনকারী মোছা: সাবিনা বিবি, শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী মোছা: শাহানাজ বেগম, সফল জননী মোছা: মোমেনা বিবি, নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যোমে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে মোছা: ছালমা ও সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখার জন্য মোছা: ফেমী বিবি। এছাড়াও সফল জননী মোছা: মোমেনা বিবি জেলা পর্যায়েও শ্রেষ্ঠ হয়েছেন।
সফল জননী উপজেলার গুয়াতা গ্রামের মোছা: মোমেনা বিবি বলেন তার পরিবার মাত্র ১০বছর বয়সে উপজেলার গুয়াতা গ্রামের আহম্মদ আলী আকন্দ নামের এক কৃষকের সঙ্গে বিয়ে দেয়। পড়ালেখা করার কোন সুযোগ পাননি। বিয়ের পর ঘরে আসে তিন ছেলে ও দুই মেয়ে। অনেক কষ্ট করে জায়গা জমি বিক্রি করে ছেলে-মেয়েদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছি। এক বছর বন্যায় সব ফসল নষ্ট হলে তিনি একবেলা খেয়ে সন্তানদের জন্য সামান্য হলেও খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। বছরের পর বছর এক কাপড় সেলাই করে পরিধান করেছেন। অর্থের অভাবে দূরের স্কুলে যাওয়ার জন্য সন্তানদের একটি সাইকেলও কিনে দেওয়া সম্ভব হয়নি। সবাই পাঁয়ে হেটে কয়েক কিলোমিটার দূরের স্কুলে গিয়ে পড়ালেখা করেছে। জীবনে অনেক কষ্ট করেছেন বলেই আজ তার পাঁচ সন্তানই উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রথম ছেলে ডা: মুনীর আলী আকন্দ রামেক থেকে ডাক্তারী শেষে বিদেশী ডিগ্রি অর্জন করে বর্তমানে নওগাঁর ডেপুটি সিভিল সার্জন হিসেবে কর্মরত। দ্বিতীয় ছেলে আব্দুল মজিদ মাদ্রাসার সহকারি শিক্ষক হিসেবে ও তৃতীয় ছেলে ডালিম উদ্দীন বুয়েট থেকে পড়ালেখা শেষ করে বর্তমানে বিআরটি বিভাগে সহকারি পরিচালক হিসেবে কর্মরত। চতুর্থ সন্তান রোকসানা পারভীন ঢাবি থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে অনলাইন ব্যবসায় যুক্ত আর শেষ সন্তান কাকলী দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারী পড়ালেখা শেষ করে ঢামেকে কর্মরত রয়েছে। জীবনে কষ্ট করেছেন বলে আজ সন্তানদের উচ্চ শিক্ষিত করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। বর্তমানে সন্তানদের সফলতায় তিনি একজন সফল ও গর্বিত মা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। সবকিছুর জন্য তিনি সব সময় মহান আল্লাহর দরবারে লাখো কোটি শুকরিয়া আদায় করেন।
শিক্ষা ও চাকরী ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী উপজেলার খাগড়া গ্রামের অদম্য নারী মোছা: শাহানাজ বেগম বলেন তার বাবা সরকারের সামান্য একজন কর্মচারী ছিলেন। তার পরিবারে অনেকগুলো ভাই-বোন ছিলো। ফলে পরিবারে সব সময় অভাব লেগেই থাকতো। যার কারণে তাকে অনেক কষ্ট করে পড়ালেখা করতে হয়েছে। বিশেষ করে তিনি টিউশনি করে তার পড়ালেখার খরচ যোগার করেছেন। এছাড়া সমাজের নানা কুসংস্কার ও বাঁধা বিপত্তির সম্মুখিন হতে হয়েছে তাকে। তবুও উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার দৃঢ় মনোবল আর কঠোর পরিশ্রমের কোন কমতি ছিলো না তার মাঝে। যার কারণে অনেক কষ্ট করে রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে বর্তমানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। লক্ষ্যকে অটুট রেখে দৃঢ় মনোবল নিয়ে পথচলা শুরু করলে জীবনে সফলতা একদিন না একদিন আসবেই।
অর্থনৈতিক ভাবে সাফল্য অর্জনকারী উপজেলার জামালকুড়ি গ্রামের অদম্য নারী মোছা: সাবিনা বিবি জানান একসময় তিনি পরিবার নিয়ে খুব অভাবে দিনানিপাত করতেন। তিনি ডাসকো নামক এক এনজিওর সহযোগিতায় ২টি ছাগল নিয়েছিলেন। সেই ২টি ছাগল থেকে বর্তমানে তার ১৭টি ছাগল, ১টি গরু ও ৭০টি হাঁস রয়েছে। এই গবাদিপশুগুলো পর্যায়ক্রমে বিক্রি করে তিনি প্রতি মাসে গড়ে ১৫হাজার টাকা আয় করছেন। এছাড়া দুই বিঘা জমিও বন্দক নিয়েছেন। বর্তমানে তার সংসারে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ফিরেছে। তার সন্তানরা পড়ালেখা করছে। তার পরিবার থেকে অভাব নামক বাঁধা দূর হয়েছে। প্রবল ইচ্ছাশক্তি থাকলে জীবনে সফল হওয়া সম্ভব।
সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখা উপজেলার আতাইকুলা গ্রামের অদম্য নারী মোছা: ফেমী বিবি জানান তিনি একটি উন্নয়ন সংস্থার কাছ থেকে পরিবেশ প্রকল্প থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধে বিভিন্ন এলাকায় সচেতনতামূলক উঠান বৈঠক করছেন। বৃক্ষরোপন কর্মসূচিসহ বাল্য বিয়ে প্রতিরোধ ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধে উঠান বৈঠকও অব্যাহত রেখেছেন। এলাকার দু:স্থ ও অসহায় জনগনের বিভিন্ন দপ্তর থেকে সরকারি সেবা পেতে সহায়তা কেও আসছেন। সমাজ উন্নয়নে নিরলস ভাবে কাজ করার চেস্টা করে আসছেন তিনি।
নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যোমে প্রতিষ্ঠিত হওয়া উপজেলার সরিয়া গ্রামের অদম্য নারী মোছা: ছালমা জানান খুব অল্প বয়সে তার পরিবার বিয়ে দেয়। বিয়ের এক বছর পর থেকে স্বামী শারীরিক ও মানসিক ভাবে নির্যাতন শুরু করে। এরই মধ্যে এক পুত্র সন্তান আসে তাদের সংসারে। তারপরও স্বামীর নির্যাতনের মাত্রা একটুও কমে না। এক পর্যায়ে তিনি তালাক নিতে বাধ্য হন। তালাকের পর তিনি বাবার বাড়িতে এসে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগল পালন শুরু করেন। ছেলেকে শত অভাব-অনটনের মধ্যেও পড়ালেখা করে একজন ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার কাজও চালিয়ে যান। বর্তমানে তার ৩টি গরু ও ৭০টি হাঁস রয়েছে। এছাড়া সংসারের কাজের ফাঁকে সেলাইমেশিনের কাজ করেন তিনি। তার এই আয় দিয়ে নিজের সন্তানের পাশাপাশি ছোট দুই বোনের পড়ালেখার খরচ যুগিয়ে আসছেন তিনি। তার এক বোন রুয়েট থেকে পড়ালেখা শেষ করেছে। আরেক বোন ডিগ্রিতে আর তার সন্তান এইচএসসি পাশ করেছে। নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে তিনি সংসার জীবনে একজন সফল যোদ্ধা হিসেবে সফলতা অর্জন করেছেন। বর্তমানে তিনি পরিবার নিয়ে ভালো আছেন।
উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা শাহিনা আকতার বলেন আজকের এই অদম্য নারীরা সমাজের পিছিয়ে পড়া অন্য নারীদের জন্য এক মহা দৃষ্টান্তর। তাদের খুজে বের করে সম্মানিত করা আমাদের নৈতিক দায়িত্বের একটি অংশ। তাই আমরা চেষ্টা করেছি এই নারীদের ক্ষুদ্র হলেও সম্মানিত করার। আমাদের চেষ্টা আগামীতেও অব্যাহত থাকবে। তাই আমরা নারীদেরকে অবজ্ঞা আর অবহেলার দৃষ্টিতে না দেখে সমাজের সকল স্তরে তাদেরকে সফল করতে সহযোগিতা প্রদান করি। এতে করে আমাদের সমাজই আরো শক্তিশালী হবে। দেশ আরো উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাবে।
মন্তব্য (০)