
কুড়িগ্রাম প্রতিনিধিঃ কুড়িগ্রামের উলিপুরে এক সবুজ ঐতিহ্য। যা একসঙ্গে অর্থনীতি, কর্মসংস্থান ও সংস্কৃতির প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃষকের ঘাম ও মাটির গন্ধে মিশে তৈরি হয়েছে এক কৃষি সংস্কৃতি। যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বহমান। বরজের ভেতরে ঢুকলেই পানপাতার কোমল সবুজে মন ভরে যায়। এক সময় এই পান শুধু উলিপুরে নয়, আশপাশের জেলাতেও খ্যাতি অর্জন করেছিল। তবে দিনে দিনে এই ঐতিহ্যবাহী পান (বরজ) চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন চাষিরা। উৎপাদনের তুলনায় খরচ বেশি এবং ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় পানের বরজ তুলে অন্য ফসল চাষাবাদে ঝুঁকছেন চাষিরা।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার পান্ডুল, তবকপুর, ধরনীবাড়িসহ বিভিন্ন ইউনিয়নে প্রায় ২০ হেক্টর জমিতে ছোট-বড় চার শতাধিক পানের বরজ রয়েছে। বিয়ে-শাদি, উৎসব বা অতিথি আপ্যায়ন সব ক্ষেত্রেই পান-সুপারি অপরিহার্য। এটি এ অঞ্চলের সংস্কৃতি ও আতিথেয়তার পরিচয় দেয়।
পান চাষিরা জানান, বরজ তৈরির উপকরণের দাম বেশি এবং পানের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় তাদের বাপ-দাদার পারিবারিক পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। অথচ এক সময় এ অঞ্চলে পানের কদর থাকায় পান চাষে ঝুঁকি পড়েছিল অনেকেই। এসব পান চাষিদের কাছে তাদের পানের বরজগুলো ছিল একেকটি ব্যাংকের মতো। যেকোন আর্থিক প্রয়োজনে বরজ থেকে পান পাতা ছিঁড়ে তা স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে চাহিদা মেটাতেন। তবে আগে পান চাষ করেই অনেকে স্বাভলম্বী হলেও এখন নানা কারণে পান চাষিরা লোকসানের মুখে পড়ছেন।
পান্ডুল এলাকার পানচাষি মনোজিৎ কুমার জানান, এখন অনিয়মিত বৃষ্টি, অতিরিক্ত দাবদাহ এবং ঠাণ্ডার কারণে ঠিকমত পান গাছ বৃদ্ধি পায় না। এছাড়া নানান রোগবালাই পোকামাকড় তো আছেই। বাঁশ, ছন, সার ও কীটনাশকের দাম বেড়ে গেছে। আগে পাইকাররা সরাসরি বরজে এসে পান কিনে নিয়ে যেতেন। এখন বাজারে গিয়ে বিক্রি করতে হয়। ফলে খরচ কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে।
আপুয়ার খাতা গ্রামের বরজ মালিক বিমল চন্দ্র রায় বলেন, পানের বরজ দিয়ে বাবা-দাদাদের সংসার চালতো। তখন পান ছিল লাভজনক ব্যবসা। বাবা মারা যাওয়ার পর বরজ বন্ধ হয়। তারপর ২০১৫ সালে দুই ভাই পৃথকভাবে এক একর জমিতে চারটি বরজ তৈরি করি। এখন প্রতিবছর প্রতিটি বরজের জন্য ৫০ থেকে ৮০ হাজার টাকা খরচ করে বরজ মেরামত করতে হয়। সে অনুযায়ী লাভ হয় না। ভাদ্র মাস থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত কিছুটা লাভ হলেও সারা বছর ধরে লোকসান গুণতে হয়।
তবকপুর বাড়াইপাড়া গ্রামের সুকুমার রায় বলেন, আমাদের চারটি পানের বরজ রয়েছে। আগে প্রতিটি আঁটি (একশত) ৯০-১০০টাকায় বিক্রি হতো। সেই পান এখন ৫০-৬০টাকায় নেমে এসেছে। আগের তুলনায় খরচ বাড়লেও দাম কমে গেছে।পানচাষি পবিত্র চন্দ্র বলেন, আমি বাবার পৈত্রিক সূত্রে দীর্ঘদিন ধরে পানের বরজ করে আসছি। আমার কাছ থেকে শিখে এলাকার অনেকেই পানের বরজ তৈরি করে সুন্দরভাবে সংসার চালাতো। কিন্তু এখন তেমন লাভ না হওয়ায় অনেকে পানের বরজ ভেঙে ফেলে ধানসহ রবিশস্য চাষাবাদ করছেন।
চারুবালা রাণী আরেক পানচাষি বলেন, পুরুষের পাশাপাশি পানের বরজে আমরাও কাজ করি। বরজে পানি দেওয়া, গাছের পাতা পরিষ্কার করা, রোগাক্রান্ত পাতাগুলো আলাদা করা। কিন্তু বাজারে দাম কমে যাওয়ায় ঠিকভাবে পারিশ্রমিক পাওয়া যায় না।
এ বিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন বলেন,উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে চাষিরা পান চাষ করছেন। জীবন-জীবিকা নির্বাহের পাশাপাশি তারা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। আমরা উপজেলা কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে নিয়মিত এসব পান চাষিদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে থাকি।
মন্তব্য (০)