
সঞ্জু রায়, বগুড়া:.উত্তরের প্রাণকেন্দ্র বগুড়া শহরের বুক চিরে বয়ে চলেছে করতোয়া নদী। মাস কয়েক আগেও শহরবাসীর জঞ্জাল ছিলো যে নদী, সেই নদীর একাংশে যেন নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়েছে। প্রশান্তির বাতাস আর প্রকৃতির সৌন্দর্য্য ঘিরে হাঁটা-চলা, ছবি তোলা, গল্প-আড্ডায় অন্যরকম আনন্দ। নদীর তীর যেন হয়ে উঠেছে মানুষের মন ভাল করার নতুন ঠিকানা।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের ‘করতোয়া নদী পুনঃখনন ও স্লোপ প্রটেকশন’ প্রকল্পের আওতায়, ৩৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০২৪ সালের মার্চে শুরু হওয়া করতোয়া নদীর ২৮ কিলোমিটার পুনঃখননের পাশাপাশি, এসপি ব্রিজ থেকে ডিসি অফিস পর্যন্ত ৭৩০ মিটার নদী তীর রক্ষাবাঁধ ও মনোমুগ্ধকর ওয়াকওয়ে নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে ইতিমধ্যেই। ১২ ফুট প্রশস্থ পথ, তিন ফুট ড্রেন, ১৪টি রঙিন ছাতা ও বেঞ্চ সব মিলিয়ে এ যেন এক নতুন বিনোদনকেন্দ্র। শুধু তাই নয় স্থানটিতে বসানো হয়েছে ৭২টি ঝলমলে সৌরবিদ্যুৎ চালিত আলোকবাতি যা রাতের সৌন্দর্য্যেকে বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ। শুধু এ অংশেই প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১১ কোটি টাকা। তাইতো কচুরিপানা আর আবর্জনায় ঢেকে থাকা করতোয়ার একাংশের এই দৃষ্টিনন্দন রূপ দেখতে প্রতিদিনই নদীর তীরে ভিড় জমাচ্ছেন শত শত বিনোদন প্রেমী মানুষ। আর ছুটির দিনে এই ভিড় থাকে কয়েকগুণ।
অফিস শেষে নদীর তীরে ঘুরতে আসা চাকুরিজীবী কামরুল ইসলাম ও ডা: রোকনুজ্জামান সোহাগ জানান, দখল আর দূষণের আড়ালে এতদিন চাপা পড়েছিল নদীর সৌন্দর্য্য। অল্প কিছু এলাকা হলেও স্লোপ প্রটেকশন আর ওয়াকওয়ে নির্মাণের কারণে এই জায়গায় আসলে এখন মন জুড়িয়ে যায়। নির্মল বাতাস সাথে নদীর পানি সব মিলিয়ে ক্ষণিকের জন্য হলেও মেলে প্রশান্তি।
শিক্ষার্থী ফারজানা পারভীন স্থানটিতে ঘুরতে এসেছেন তার বান্ধবীদের সাথে। হাতে ঝাল মুড়ির প্যাকেট নিয়ে নদীর পাড়ে মুক্ত পরিবেশে মেতে উঠেছেন গল্প আড্ডা আর সেলফিতে। সকলকে সাথে নিয়ে জানালেন, বগুড়া উত্তরবঙ্গের প্রাণকেন্দ্র হলেও এই শহরে বিনোদন কেন্দ্রের বড়ই অভাব। তারা কখনো ভাবতেও পারেনি একসময়ের জঙ্গল ও দূষিত পরিবেশ এত সুন্দর হবে। সারাদিন স্কুল আর প্রাইভেটের ক্লান্তি শেষে এখন সময় পেলেই তারা ছুটে আসেন এই নদী তীরে একটু প্রশান্তির খোঁজে।
শুধু ফারজানা নয় তার মত অনেক তরুণ বয়সী ছেলে মেয়েরা মুক্ত পরিবেশে খুঁজে নিয়েছে তাদের আপন ঠিকানা। অনেকে তো আবার সন্ধ্যা লাগলেই মেতে ওঠে নদীর তীরে গিটারের সুরের সাথে গানের আসরে। শুধু উঠতি বয়সী ছেলে মেয়েরাই নয় নদীর তীরে এখন প্রতিদিন ভীড় জমাচ্ছেন নানা বয়সী ও নানা পেশার মানুষ। কেউ হাঁটতে আসেন আবার কেউবা সন্তানকে নিয়ে একটু সময় কাটাতে। নদীর পানি বাড়ায় অনেকে আবার জীবনে প্রথমবারের মতো অভিজ্ঞতা নিচ্ছেন নৌকা ভ্রমণের। ভাবতে পারেন এক সময় দখল দূষণে যে করতোয়ার মৃতপ্রায় অবস্থা ছিল সেখানে আজ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে নৌকা। এই দৃশ্যই তো দেখতে চেয়েছিল বগুড়াবাসী।
তবে স্থানীয়রা বলছেন, সৌন্দর্যবর্ধনের পাশাপাশি এখন একদিকে যেমন করতোয়ার পানি দূষণমুক্ত রাখতে হবে অন্যদিকে শুধু করতোয়ার এই অংশ নয় এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে শাজাহানপুর থেকে মাটিডালি পর্যন্ত। গড়ে তুলতে হবে নদীকেন্দ্রিক পর্যটন। বিদেশে শহরের ভিতরে থাকা নদীগুলোকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক বিকাশ হচ্ছে অথচ আমাদের দেশে প্রাকৃতিক এত সম্পদ থাকার পরেও আমরা তার সঠিক ব্যবহার করতে পারছি না। বগুড়া শহরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া এই করতোয়া নদীকে যদি সুপরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করা যায় তাহলে একদিকে যেমন সড়কে চাপ কমবে অন্যদিকে সাধারণ মানুষের মাঝেও স্বস্তি ফিরবে।
সার্বিক প্রসঙ্গে পানির উন্নয়ন বোর্ড বগুড়ার নির্বাহী প্রকৌশলী নাজমুল হকের সাথে কথা বললে তিনি জানান, উদ্বোধনের আগেই করতোয়া নদীর ৭৩০ মিটার অংশে সাধারণ মানুষের যে ভিড় জমছে তা সত্যিই অন্তরে প্রশান্তি যোগায়। নদীর প্রাণ বাঁচানোর পাশাপাশি এই স্থান এখন হয়ে উঠেছে মানুষের কাছে একটি বিনোদন কেন্দ্র। সুদীর্ঘ বছর দখল আর দূষণে যেভাবে করতোয়া নদীকে মৃতপ্রায় অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সে অবস্থা থেকে নদীতে নতুন প্রাণের সঞ্চার ঘটাতে তারা নানাবিধ পরিকল্পনা করে যাচ্ছেন। তবে নদীর এই দৃষ্টিনন্দন রূপ ধরে রাখার দায়িত্ব নিতে হবে আমাদের সকলকেই। এছাড়াও তিনি জানান, অনুমোদন প্রাপ্তি সাপেক্ষে করতোয়া নদী সিস্টেম নামে এক বৃহৎ প্রকল্পের আওতায় নদীর আশপাশের খাল খনন ও শহর অংশে বনানী থেকে মাটিডালি পর্যন্ত স্লোপ প্রটেকশনসহ ওয়াকওয়ে নির্মাণ কাজ হাতে নেওয়া হবে। যেখানে প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১১'শ কোটি টাকা।
করতোয়া ঘিরে গড়ে উঠুক নদীকেন্দ্রিক পর্যটন। নদীর জলে দূষণ নয় দাপিয়ে বেড়াক পর্যটকবাহী নৌকা, সাধারণ মানুষ শ্বাস নিক প্রকৃতির বাহুডোরে এমনই প্রত্যাশা সকলের।
মন্তব্য (০)