
নিউজ ডেস্ক : মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদ বলেছেন, প্রশাসন হেরে গেছে। কারণ, গত নির্বাচনগুলোয় প্রশাসন নিজের মহিমা দেখাতে পারেনি। তবে আগামী দিনে ভালো নির্বাচন উপহার দিতে প্রশাসন অধীর আগ্রহে আছে। আমার সহকর্মীরাও এ আশা পোষণ করেন। কিন্তু নির্বাচন শুধু প্রশাসনের একার বিষয় নয়।
রোববার বিকালে ঢাকায় অফিসার্স ক্লাব আয়োজিত ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চেতনায় জাতীয় নির্বাচনে জনপ্রশাসনের ভূমিকা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
অফিসার্স ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সাবেক সচিব এবিএম আব্দুস সাত্তারের সভাপতিত্বে ও সাবেক সচিব আব্দুল খালেকের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় আলোচক হিসেবে বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনীতি বিশ্লেষক ডা. জাহেদ উর রহমান এবং যুগান্তরের উপসম্পাদক বিএম জাহাঙ্গীর।
ড. শেখ আবদুর রশীদ আরও বলেন, আমাদের দেশের মানুষ হানাদারদের বিরুদ্ধে বীরের মতো দাঁড়িয়েছিলেন। আবার কাপুরুষের মতো অন্যের অধিকারও হরণ করেছে। একসময় মানুষ ছাত্রদের মাথায় তুলে রাখতেন, আবার তাদের এড়িয়ে চলতেও দেখেছি। এ দেশের মানুষ সহজেই ভুলে যায়, ভুলে থাকতে চায়।
তিনি বলেন, ১৯৭৪ সালে আমাদের জাতীয় স্মৃতিসৌধে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ফুল দিতে দেখেছি। অথচ চার বছর আগে তিনি ছিলেন বাংলাদেশিদের কাছে খুবই ঘৃণার পাত্র। তিনি ঢাকায় এলে তাকে স্বাগত জানাতে লাখ লাখ মানুষ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। কী অদ্ভুত পরিবর্তন অল্পসময়ের ব্যবধানে।
আবদুর রশীদ বলেন, ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে পবিবর্তনের কথা আমাদের মনে আছে। আমাদের একটি গৌরবময় ঘটনা রয়েছে। কিন্তু আমরা সেই স্মৃতি কাজে লাগাতে পারিনি। আমরা সেখানে হেরে গেছি। এর ফলে আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। আমাদের কিছু জিনিস ভুলে যাওয়া এবং অনেক কিছু মনে রাখা উচিত। তিনি বলেন, শুধু প্রশাসন আর গণমাধ্যম নয়, বরং সব স্তর থেকে দলীয় সংকীর্ণতা ভুলে যাওয়া উচিত। আমাদের পেশাদারি অর্জন করা উচিত।
আলোচক হিসেবে ডা. জাহেদ উর রহমান বলেন, কথা এসেছে অনুকূল পরিবেশ পেলে প্রশাসন ঠিকঠাক কাজ করে। তিনি বলেন, আমি যদি নাগরিক হিসেবে প্রশ্ন করি- আপনারা অনুকূল পরিবেশ পেলে কাজ করবেন, আপনাদের সঙ্গে কি আমার এ ধরনের কমিটমেন্ট হয়েছে? এটা অফিসার্স ক্লাব, কিন্তু আমাদের সংবিধানে তো অফিসার বলে কোনো কথা নেই। সেখানে মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ সবাই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। আমরা সরকার আর প্রজাতন্ত্রকে গুলিয়ে ফেলেছি। পাবলিক কলেজকে সরকারি কলেজ বলা হয়। এটা ঠিক না। পাবলিক মানে অবশ্যই সরকার না। ফলে সব জায়গায় সরকারিকরণ করার চেষ্টা করা হয়।
ডা. জাহেদ আরও বলেন, মনে করা হয় আমাকে সরকারের সব কথা শুনতে হবে। না, সরকারের সব কথা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা শুনতে বাধ্য নয়। না শুনলে কী হবে? পদোন্নতিবঞ্চিত হবেন? সরকারের বেআইনি আদেশ মানা বাধ্যতামূলক নয়। কোনো পুলিশ অফিসার কি বলতে পারবেন, আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে বলে আমি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড করেছি। এসব বলার কোনো সুযোগ নেই। সুতরাং এ খোলস থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
আলোচক হিসেবে যুগান্তরের উপসম্পাদক বিএম জাহাঙ্গীর বলেন, অনুষ্ঠানের শুরুতে দেখানো ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের শহীদদের আত্মদানের ডকুমেন্টারির শেষের লাইনটা ছিল- ‘আমরা তোমাদের ভুলব না’। কিন্তু এটা কি আসলে আমরা সত্য বলছি? আমার তো মনে হয়, আমরা তাদের ভুলে গেছি। গত এক বছর আমরা দেশ ঠিক করার নামে প্রতিটি জায়গায় যা যা করেছি এবং এখনো যা করেই চলছি, এতে প্রমাণ করে আমরা জুলাই যোদ্ধাদের সে মর্যাদা দিতে পারিনি, বাস্তবতা বলছে- তাদের ভুলে গেছি। যা বলছি বলার জন্য বলছি। লোকদেখানোর জন্য বলছি। সত্যিকার অর্থে এই রক্তদান, জীবনদান এবং শহীদদের পরিবারের কান্না যদি আমরা ধারণ করি, তাহলে এ অবস্থা হওয়ার কথা না। তিনি আরও বলেন, আজ আমরা উন্মুক্ত বাংলাদেশে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছি। কথা বলছি। কিন্তু কাদের রক্তের বিনিময়ে কথা বলছি? মৃত্যু কি এতই সহজ? যারা জীবন দিয়ে গেল, তাদের আমরা কতটা মনে রাখতে পেরেছি, তা তো সচিবালয়ের দিকে তাকালে বোঝা যায়। একবার ভাবুন তো- সাভার বাসস্ট্যান্ডে ইয়ামিনের লাশ পুলিশের এপিসি থেকে যখন ফেলে দেওয়া হচ্ছিল, তখনো সে বেঁচে ছিল। সেই দৃশ্য কি সবাই ভুলে গেছেন? আমাদের কর্মকাণ্ড বলছে, আমরা সেসব ভুলে গেছি। আমার প্রশ্ন- আপনারা কাদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে পতাকা উড়ান, কাদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে এসব চেয়ার ভোগ করছেন? একবার ভাবুন।
বিএম জাহাঙ্গীর আরও বলেন, অন্যায়ভাবে যাদের বঞ্চিত করা হলো, অথচ তাদের পদোন্নতি দিতে এত সময় লাগল কেন? এটা তো লজ্জার বিষয়। বিগত সাড়ে ১৫ বছরে আওয়ামী দুঃশাসনের সময় যেসব কর্মকর্তা সচিবালয়কে রীতিমতো দলীয় কার্যালয়ে পরিণত করেছিলেন, যারা আমাদের জাতি ও প্রশাসনের জন্য কলঙ্ক, তারা তো সমাজে চিহ্নিত; কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে আপনারা কী ব্যবস্থা নিয়েছেন?
মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) যেসব সদস্য দফায় দফায় মেধাবী কর্মকর্তাদের বঞ্চিত করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছেন? জবাব আপনাদের দিতেই হবে। এসএসবির সামারি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গিয়ে পরিবর্তন হয়ে গেছে, এর জবাব বের করতেই হবে। তারা কারা? তারা পরস্পর ব্যাচমেট। এক ব্যাচমেট অপর ব্যাচমেটের পদোন্নতি খেয়ে দিয়েছে। অথচ তারা এখনো চেয়ারে বসা। তারা কীভাবে এখনো ওই পদে দায়িত্ব পালন করছেন?
বিএম জাহাঙ্গীর আরও বলেন, সাড়ে ১৫ বছরে অসংখ্য লোক গুম-খুন হয়েছে। মামলা-হামলায় শিকার হয়েছে, কত দুঃখ-বেদনা নিয়ে মানুষ দিন পার করেছেন। কিন্তু আমার মনের ভেতরে একধরনের কষ্ট রয়েছে, তা হলো বিগত সাড়ে ১৫ বছরে অসংখ্য কর্মকর্তাকে জামায়াত ও বিএনপি ট্যাগ দিয়ে পদোন্নতিবঞ্চিত করেছে। অথচ দলীয় পরিচয়ধারী কর্মকর্তা ৫ শতাংশও হবে না। এ সংখ্যা খুবই সীমিত। কিন্তু অসংখ্য মেধাবী কর্মকর্তাকে বাদ দিলেন কেন? যারা এসব অন্যায় করেছেন, গত এক বছরে তাদের বিচার কেন হয়নি? বিগত সরকারের সময় যারা প্রকাশ্যে দলবাজি করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে?
তিনি বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে কোনো দলের না। বরং প্রতিটি সরকার আমাকে প্রতিপক্ষ দলের লোক হিসাবে ট্যাগ দিয়েছে। আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরেও চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে দিনাতিপাত করতে হয়েছে। একটি প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থা থেকে বারবার চাকরিচ্যুতির হুমকি এসেছে। কিন্তু আপস করিনি। যমুনা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম সেসব হুমকি-ধমকিকে পাত্তা দেননি। নিজে সবকিছু ফেস করেছেন। কিন্তু সাংবাদিকদের কারও কোনো ক্ষতি হতে দেননি। এরকম সাহসী গণমাধ্যম মালিক এখন আমাদের সমাজে কজন আছেন।
বিএম জাহাঙ্গীর আরও বলেন, রাজনীতি যদি রাষ্ট্রের মাথা হয় তবে সংবাদপত্র বা গণমাধ্যম হচ্ছে রাষ্ট্রের চোখ। গত এক বছরে আপনারা কী করেছেন, চিন্তা করে দেখুন। তিনি বলেন, আমার বিবেচনায় শেখ হাসিনার দুটি কারণে পতন হয়েছিল। একটি হলো- দল ও জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন। কারা তাকে দল ও জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে- একশ্রেণির আমলা। আরেক শ্রেণির সাংবাদিকদের তৈলমর্দন ও তেলবাজির কারণে শেখ হাসিনার পতন হয়েছে। আবার ওই সারির সাংবাদিকের প্রশ্নের কারণেই বলা যায় ৫ আগস্ট সৃষ্টি হয়েছিল।
কর্মকর্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা দলবাজি করবেন না। আজ শপথ নিতে হবে। দলবাজি আগে নিজেদের ছাড়তে হবে এবং প্রশাসনকে দলবাজিমুক্ত করতেই হবে। প্রশাসন দলবাজ হলে ভবিষ্যতে বিএনপি ক্ষমতায় এলে তাদের জন্য ক্ষতির কারণ হবে। বিএনপির দায়িত্বশীলদের উদ্দেশে তিনি বলেন, যে আমলা রাজনীতি করতে চান, তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেবেন না। এটা দেশ ও দলের ক্ষতি। কর্মকর্তাদের বলি, পদ-পদবি ও পদোন্নতির জন্য রাজনীতিতে জড়াবেন না। এ মুহূর্তে আরও একটি কাজ করা দরকার। তা হলো গণমাধ্যমকে ঠিক করা। গত এক বছরে গণমাধ্যম ঠিক হয়নি। আবারও একশ্রেণির সাংবাদিক প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি ক্ষমতায় এলে তারা কী পাবে? তাহলে আমার প্রশ্ন- এ গণ-অভ্যুত্থান, এ রক্ত, এত শাহাদত এবং যাদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আমরা এসব ক্ষমতা ভোগ করছি; তাহলে জনগণের যে আকাঙ্ক্ষা সেটির কী হবে, কী লাভ হবে দেশের? কিছুই হবে না। আসলে কোনো পরিবর্তনই হবে না।
মন্তব্য (০)