নিউজ ডেস্ক : আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল—কবি, দার্শনিক, ন্যায়বিদ এবং বিংশ শতাব্দীর অন্যতম মৌলিক মুসলিম চিন্তাবিদ—নৈতিক ও অর্থনৈতিক পুনর্জাগরণ খুঁজে বেড়ানো জাতিগুলোর জন্য এখনো এক বিশাল দিশারী। ইকবালের কাছে অগ্রগতি কখনো কেবল বস্তুগত অর্জনের বিষয় ছিল না; এটি ছিল মানবিক সম্ভাবনার বিকাশ এবং সামষ্টিক মর্যাদার দৃঢ়ীকরণ।
তার দৃষ্টিতে দারিদ্র্য ছিল শুধু অর্থনৈতিক বঞ্চনা নয়, বরং এক মানসিক অবস্থা—যা আত্মবিশ্বাস ক্ষয় করে, সৃজনশীলতা স্তব্ধ করে এবং মানবিক স্পৃহাকে দুর্বল করে তোলে।
তার প্রাথমিক অর্থনৈতিক গ্রন্থ ‘ইলমুল ইকতিসাদ’-এ ইকবাল যুক্তি দেন যে, অর্থনৈতিক শক্তির ভিত্তি নিহিত বুদ্ধিবৃত্তিক সাহস ও নৈতিক উদ্দেশ্যে। তিনি বিশ্বাস করতেন, কোনো জাতি তার অনুসন্ধানের ক্ষমতা ও সৃজনশীল মিশনের প্রতি আস্থা হারালে তার পতন অনিবার্য। শত বছর পর পাকিস্তানের সংকটেও সেই সতর্কবাণীর প্রতিধ্বনি শোনা যায়—আমাদের সংকট কেবল অর্থনৈতিক নয়, সভ্যতাগতও বটে।
আজ পাকিস্তান ঋণচাপ, উৎপাদনশীলতার ঘাটতি ও প্রাতিষ্ঠানিক স্থবিরতার মুখে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় সংকট হলো আত্মবিশ্বাসের সংকট—নিজেদের ক্ষমতার ওপর বিশ্বাস হারানো। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তরুণ জনগোষ্ঠী নিয়ে গঠিত এই জাতি (১৪ কোটি তরুণ), আজ আকাঙ্ক্ষা ও বিভ্রান্তির মাঝামাঝি অবস্থায় ঝুলে আছে।
এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে আমাদের ফিরতে হবে ইকবালের ‘খুদি’ দর্শনে—যেখানে আত্মনিয়ন্ত্রণ, দায়িত্ববোধ ও নৈতিক স্বাধীনতার ভিত্তিতে গঠিত সৃজনশীল ব্যক্তিত্বই অগ্রগতির চাবিকাঠি। খুদি আত্মঅহমিকা নয়; এটি আত্মসম্মান ও আত্মরূপান্তরের নীতি—যেখানে মানুষ বিশ্বাস করে যে, অধ্যবসায়, সাহস ও দৃঢ় বিশ্বাসের মাধ্যমে সে নিজের ভাগ্য নিজেই নির্মাণ করতে পারে।
ইকবালের মেধা এইখানেই—তিনি পাশ্চাত্যের আধুনিক চিন্তাধারার সঙ্গে সংলাপ করেছেন, কিন্তু নিজের পরিচয় হারাননি। কান্টের কাছ থেকে শিখেছেন নৈতিক স্বাধীনতা, নীটশের কাছ থেকে জীবনকে স্বীকার করার সাহস, এবং বার্গসনের কাছ থেকে সৃজনশীল বিবর্তনের ধারণা।
কিন্তু তিনি কাউকে অন্ধভাবে অনুসরণ করেননি; বরং সমালোচনামূলকভাবে গ্রহণ করে ইসলামি আধ্যাত্মিকতা ও মানব ঐক্যের ভিত্তিতে এক নিজস্ব দর্শন নির্মাণ করেছেন।
আজ পাকিস্তানের জন্যও এই মনোভঙ্গিই প্রয়োজন—না অতীতের কঠোর ঐতিহ্যে বন্দি হওয়া, না বিদেশি মডেলের অন্ধ অনুকরণ। আমাদের পথ হতে হবে নৈতিক, তথ্যনির্ভর, ভবিষ্যতমুখী ও নিজস্ব বাস্তবতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।
এই চিন্তাধারার ওপর দাঁড়িয়ে গঠিত হয়েছে ‘উড়ান পাকিস্তান’ উদ্যোগ—যা কোনো স্লোগান বা প্রকল্পের তালিকা নয়; এটি এক উন্নয়ন দর্শন, যার কেন্দ্রবিন্দু মানুষ। এর লক্ষ্য তরুণদের ভবিষ্যৎ দক্ষতায় প্রশিক্ষিত করা, ডিজিটাল ও উদ্ভাবননির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলা, প্রতিষ্ঠানগুলোকে দক্ষ ও সহমর্মী করা, ন্যায়, টেকসই উন্নয়ন ও অন্তর্ভুক্তির নীতিতে নীতি নির্ধারণ করা। মূল বার্তা হলো—অর্থনৈতিক পুনরুত্থান ও নৈতিক নবজাগরণ অবিচ্ছেদ্য।
ইকবালের ‘শাহিন’ (ঈগল) প্রতীক আজ পাকিস্তানের জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। শাহিন কেবল কাব্যিক রূপক নয়, এটি এক শিক্ষা আদর্শ—স্বাধীন চিন্তা, দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি, অন্বেষণের স্পৃহা, শৃঙ্খলা ও মর্যাদার প্রতীক। ‘বাল-এ-জিবরিল’-এ তিনি লিখেছিলেন—
‘তুমি এক শাহিন; তোমার পেশা হলো উড্ডয়ন।
আকাশের ওপারে আরও আকাশ আছে তোমার জন্য।’
যে দেশে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তরুণ জনগোষ্ঠী, তাদের জন্য এটি জাগরণের আহ্বান। জ্ঞান, দক্ষতা ও উদ্দেশ্য দিয়ে এই শক্তিকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারলেই পাকিস্তান জ্ঞানে-নেতৃত্বাধীন বিশ্বে প্রতিযোগিতা করতে পারবে।
ইকবাল বিশ্বাস করতেন, জাতির ভাগ্য নির্ধারণ করে তাদের জ্ঞানের ক্ষমতা। ‘রিইকনস্ট্রাকশন অব রিলিজিয়াস থট ইন ইসলাম’-এ তিনি দেখিয়েছেন, ইসলাম মূলত গতিশীল, যুক্তিনির্ভর ও ভবিষ্যতমুখী ধর্ম—যা অনুসন্ধান, চিন্তন ও উদ্ভাবনকে উৎসাহ দেয়।
তবে তিনি মুসলিম বিশ্বের বৈজ্ঞানিক চেতনার পতনে গভীর উদ্বেগও প্রকাশ করেছিলেন। এক কবিতায় তিনি বলেন—
‘ভোরে স্বর্গ থেকে এক আর্তনাদ নামে:
কেমন করে হারালে তোমার জ্ঞানের রত্ন?
কেন মলিন হলো অনুসন্ধানের তরবারি?
কেন তোমার দৃষ্টিতে তারা আর কাঁপে না?’
এবং উপসংহারে ইকবাল ঘোষণা দেন—
‘নতুন ভাবনা থেকেই জন্ম নেয় নতুন জগৎ;
ইট-পাথর দিয়ে সভ্যতা গড়ে না।’
এই অন্তর্দৃষ্টি থেকেই ‘উড়ান পাকিস্তান’ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বায়োটেকনোলজি, জ্ঞাননির্ভর অর্থনীতি, গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়, ডিজিটাল প্রশাসন, শিক্ষা ও উদ্ভাবনভিত্তিক শিল্পে বিনিয়োগ করছে।
ইকবালের মতে, জ্ঞান-অন্বেষণই পুনর্জাগরণের পদ্ধতি, আর ভালোবাসা—বিশেষত নবী মুহাম্মদ (সা.)–এর প্রতি ভালোবাসা—হলো তার শক্তির উৎস। তার বুদ্ধিবৃত্তিক ও আধ্যাত্মিক আত্মবিশ্বাস এই ভালোবাসা থেকেই উদ্ভূত।
তিনি ঘোষণা দেন—
‘যদি তুমি মুহাম্মদ (সা.)–এর প্রতি অনুগত থাকো,
তবে সবকিছু তোমার—
তোমার সামনে পৃথিবীই নয়, লওহ ও কলমও নত।’
ইকবালের কাছে এটি কেবল আধ্যাত্মিক প্রেম নয়, বরং নৈতিক ও সামাজিক দিকনির্দেশনা—ন্যায়, জ্ঞান, সহমর্মিতা, সাহস ও মানবসেবার মূল্যবোধের সঙ্গে নিজের জীবনকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা। এই সামঞ্জস্যই জাতিকে খুদি-চেতনায় উদ্দীপ্ত করে, উদ্দেশ্যকে তীক্ষ্ণ করে এবং নৈতিক শক্তিতে উজ্জীবিত করে তোলে।
ইকবালের ‘রিইকনস্ট্রাকশন’ আহ্বান জানায়—ইজতিহাদের দরজা পুনরায় উন্মুক্ত করা, বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতাকে সংহত করা, ধর্মকে অগ্রগতি ও ন্যায়ের সহচর হিসেবে পুনরাবিষ্কার করা, এবং এমন এক সমাজ নির্মাণ করা যা নৈতিক, জ্ঞাননির্ভর ও ভবিষ্যতমুখী।
খুদি দর্শনের অর্থনৈতিক দিকও গভীর। যে জাতি ধার করা ভাবনা ও আত্মবিশ্বাসে নির্ভর করে, সে মর্যাদার সঙ্গে উঠতে পারে না। অর্থনৈতিক স্বাধীনতার শুরু হয় বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা থেকে—নিজেদের ভাবতে, উদ্ভাবন করতে ও গড়তে পারার বিশ্বাস থেকে।
ইকবালের স্বপ্নের রাষ্ট্র ছিল ন্যায় ও করুণার ওপর ভিত্তি করে গঠিত এক নৈতিক রাষ্ট্র—ধর্মতন্ত্র নয়, বরং ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা। পাকিস্তানকে নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রিক ঔপনিবেশিক কাঠামো থেকে বেরিয়ে এসে কর্মক্ষমতা-নির্ভর, প্রযুক্তিনির্ভর ও নাগরিক-কেন্দ্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হতে হবে। এর জন্য দরকার স্বচ্ছ প্রশাসন, যোগ্যতা-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান, তথ্যনির্ভর পরিকল্পনা, জবাবদিহিতা ও নীতিনিষ্ঠ ধারাবাহিকতা।
সবশেষে, পাকিস্তানের অগ্রগতির প্রকৃত পরিমাপ জিডিপি নয়; বরং বিশ্বাস, চরিত্র ও ঐক্য।
আমাদের নবজাগরণ শুরু হবে খুদি পুনরুদ্ধার, জ্ঞানান্বেষণের আগুন পুনরায় জ্বালানো, শাহিনের চেতনা ধারণ এবং নবী (সা.)–এর প্রেম থেকে শক্তি আহরণের মাধ্যমে।
ইকবালের আহ্বান এখনো প্রতিধ্বনিত— ‘উঠো। কাজ করো। আগামীর মালিকানা ফিরে পাও’।
লেখক: আহসান ইকবাল। পাকিস্তানের পরিকল্পনা, উন্নয়ন ও বিশেষ উদ্যোগ বিষয়ক ফেডারেল মন্ত্রী। তিনি টুইটার/সামাজিক মাধ্যমে লেখেন @betterpakistan নামে। মূল নিবন্ধ প্রকাশ করেছে জিও নিউজ।
মন্তব্য (০)