• বিশেষ প্রতিবেদন

শেরপুরের গারো পাহাড়ে বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্যের তাঁত শিল্প, ছন্দপতনে অসহায় আদিবাসীরা

  • বিশেষ প্রতিবেদন
  • ১০ মে, ২০২১ ১২:২৯:০৪

ছবিঃ সিএনআই

শেরপুর প্রতিনিধিঃ   গারো পাহাড়ের বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-তাত্তি¡ক পল্লীতে একসময় দিন-রাত শোনা যেতো যে তাঁতের খটখট শব্দ আর তাঁত বুনন ও গোত্রীয় পোশাক উৎপাদনে ব্যস্ত থাকতো সেইসব পল্লীর কারিগররাÑ কালের আবর্তে আজ সেই শব্দ তো দূরের কথা, খোদ তাঁত শিল্পই বিলুপ্তির পথে। যে কারণে সেইসব তাঁতের সাথে জড়িত কারিগর ও তাঁতের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়াই দুরূহ।

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে শেরপুরের সীমান্তবর্তী গারো পাহাড়ি এলাকার ক্ষুদ্র নৃ- তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্য বিলুপ্তপ্রায় তাঁত শিল্পের ওই চিত্র পাওয়া গেছে। আর
স্থানীয় প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসিনতা, পৃষ্ঠপোষকতার অভাব ও শ্রমি সংকটের কারণে ঐতিহ্যের তাঁত শিল্পে নেমে এসেছে ওই অবস্থা। অন্যদিকে অস্তিত্ব সংকটের কারণে ওই পেশার সাথে জড়িতদের জীবনে নেমে এসেছে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ, কেউবা পেটের দায়ে চলে গেছেন অন্য পেশায়। এছাড়া ওইসব এলাকার গারো, কোচ, ডালু, বানাই, হদি, বর্মনসহ বিভিন্ন গোত্রের মানুষ সহজলভ্যে নিজেদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক না পেয়ে বাঙালিদের পোশাক পড়তে বাধ্য হচ্ছেন।

জানা যায়, শেরপুরের সীমান্তবর্তী গারো পাহাড় এলাকার নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদী উপজেলায় রয়েছে ৩০ হাজার ক্ষুদ্র নৃ-তাত্তি¡ক জনগোষ্ঠীর বসবাস। এছাড়া সদর উপজেলা ও নকলা উপজেলায় রয়েছে ওই জনগোষ্ঠীর আরও প্রায় ৮/১০ হাজার মানুষের বসবাস। এদের মধ্যে কেউ কেউ শত শত বছর ধরে তাদের ঐতিহ্য ধরে রেখে গামছা, লুঙ্গি, দক শাড়ি, দক মান্দা, বিছানার চাদরসহ বিভিন্ন পোশাক নিজেরাই তৈরী করে ব্যবহার করে আসলেও সম্প্রতি জীবন-জীবিকার তাগিদে তাঁত শিল্প ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গিয়েছেন। আবার সুতার মূল্য বৃদ্ধিসহ নানা প্রতিকুল পরিবেশের কারণে প্রায় ৮ থেকে ১০ বছর আগেই গারো ও কোচ সম্প্রদায়ের মানুষ তাদের তাঁত বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। ফলে ওইসব গারো ও কোচ সম্প্রদায়ের বাড়িতে এখন ঘুন ও উইপোকা ধরা কাঠের তাঁতগুলো ক্ষুদ্র নৃ-তাত্তি¡ক জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যের বিলুপ্তপ্রায় কালের সাক্ষী হয়ে থাকা দু’চারটে তাঁত মেশিন চোখে পড়ে।

সরেজমিনে গেলে ঝিনাইগাতী উপজেলার একেবারে সীমান্তবর্তী রাংটিয়া ও জারুলতলা গ্রামে গেলে ওই এলাকার তাঁতমেশিনগুলো অনেকটা ধ্বংসস্তুপের মতো ও পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণে নেই কোন উদ্যোগ। ওই বিষয়ে কথা হয় রাংটিয়া এলাকার তাঁতী জাগেন্দ্র কোচের সাথে। তিনি জানান, ওইসব তাঁতে গামছা, লুঙ্গি, মহিলাদের দক শাড়ী, বিছানার চাদরসহ বিভিন্ন পোশাক বোনানো হতো এবং ওইসব পোশাকের চাহিদাও ছিলো প্রচুর। গ্রাম থেকেই সব বিক্রি হয়ে যেতো। কিন্তু এখন খোদ শিল্পই বিলুপ্তির পথে। এরপরও তারা তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক শিল্পকে পুনরায় ফিরিয়ে আনতে চান। কিন্তু একদিকে সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতার অভাব, অন্যদিকে রয়েছে তীব্র শ্রমিক সংকট। আর্থিক সংকট দূর হলে পুরনো শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব অথবা প্রশিক্ষণ দিয়ে নতুন শ্রমিক তৈরি করাও সম্ভব। আর জারুলতলা গ্রামের তাঁতী মিত্র সাংমা বলেন, পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এক মাসের মধ্যে তাঁতশিল্পগুলো পুনরায় চালু করা যাবে। সেইসাথে ওই শিল্পের সাথে জড়িতদের মাঝে ফিরে আসতে পারে চাঞ্চল্য।

অন্যদিকে একসময় তাঁতশিল্পের সাথে জড়িত শ্রমিক প্রণব কোচসহ কয়েকজন জানান, মজুরি না পোষানোর কারণে অনেক শ্রমিক তাদের এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন। কেউ বা আবার ঢাকায় পাড়ি জমিয়েছে জীবিকার তাগিদে। এদিকে, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির এক নারী জানান, তাঁত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের ঐতিহ্যের পোশাক না পেয়ে বাঙালিদের শাড়ি পড়তে বাধ্য হচ্ছেন তারা। কোচ নেতা যুগল কোচ জানান, আমাদের ঐতিহ্যের তাঁত ও পোশাক রক্ষায় একসময় কারিতাস কিছু সহযোগিতা করলেও এখন আর কেউ খোঁজ নিচ্ছে না। তবে সরকার থেকে কোনো সহযোগিতা পেলে আবার আমাদের এ ঐতিহ্য ফিরে আসতে পারে। ইতোমধ্যে দেশের পার্বত্য এলাকার চাকমা ও মণিপুরি তাঁত সরকারি-বেসরকারি নানা সংস্থার সহযোগিতায় বিলুপ্তের হাত থেকে বেঁচে উঠেছে। আমরাও চাই আমাদের শেরপুরের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের প্রতি সরকারি-বেসরকারি কোনো সংস্থা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিক।

জেলা ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) ব্যবস্থাপক তামান্না মহাল জানান, ঐতিহ্যের তাঁতশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের আওতায় ঋণসহ প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার সুযোগ রয়েছে। কাজেই গারো পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃ- তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর তাঁতীদের অবস্থার খোঁজ নিয়ে ওই সহায়তার আওতায় আনার
চিন্তা করা হবে।

এ ব্যাপারে ঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুবেল মাহমুদ বলেন, গারো পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্পকে পুরোনো রূপে ফিরিয়ে আনতে ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসনের এক মতবিনিময় সভায় নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ওই পরিকল্পনার আওতায় বিলুপ্ত প্রায় তাঁত শিল্পকে আবারও জাগিয়ে তুলতে সব ধরনের সহযোগিতা দেয়া হবে।

মন্তব্য ( ০)





  • company_logo