নিউজ ডেস্ক : কুয়াশায় ঢাকা শীতের ভোর। অ্যালার্ম বেজে উঠলেও কম্বলের ভেতর থেকে বের হওয়ার সাহস হয় না। ঠাণ্ডা মেঝেতে পা রাখার কল্পনাতেই শরীর কেঁপে ওঠে। বাথরুম যেন বরফঘর, আর কাপড় পরার পরও ঠাণ্ডা যেন শরীর ছেড়ে যেতে চায় না। প্রিয় হুডি, মোটা মোজা বা শাল— সবই তখন অকার্যকর মনে হয়। ঠিক এই সময়েই মনে হয়, এবার সত্যিই একটা রুম হিটার দরকার।
শীতের তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রুম হিটার এখন অনেক পরিবারের জন্য বিলাসিতা নয়, বরং প্রয়োজনীয় একটি গৃহস্থালি যন্ত্র। তবে শুধু হিটার কেনা আর সঠিক হিটার বেছে নেওয়ার মধ্যে রয়েছে বিশাল পার্থক্য। উষ্ণতা দেওয়াই হিটারের মূল কাজ হলেও, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিদ্যুৎ খরচ, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যঝুঁকি, বাতাসের মান ও ব্যবহারিক আরামের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
কেন হিটার কেনার সময় বিভ্রান্তি তৈরি হয়?
বাজারে ঢুকলেই চোখে পড়ে নানা নাম ও প্রযুক্তির হিটার— অয়েল-ফিলড রেডিয়েটর, কনভেকশন হিটার, কোয়ার্টজ টিউব, হ্যালোজেন, সিরামিক হিটার, ফ্যান ব্লোয়ার—সঙ্গে ওয়াটেজ, এনার্জি এফিশিয়েন্সি, থার্মোস্ট্যাট, ইকো মোডের মতো টার্ম। দামের পার্থক্যও চোখে পড়ার মতো, কিন্তু কোনটির দাম কেন বেশি—তার পরিষ্কার ব্যাখ্যা অনেক সময় পাওয়া যায় না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভুল হিটার কিনলে শীত শেষে বিদ্যুৎ বিলই হয়ে উঠতে পারে সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা। আবার কম দামের অনেক হিটারেই থাকে না প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ফিচার। যেহেতু শীতকালে হিটার প্রায় প্রতিদিন এবং দীর্ঘ সময় ব্যবহার হয়, তাই কয়েক বছরের কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নেওয়াই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।
রুম হিটারের ধরন: কোনটি কিসের জন্য উপযোগী
অয়েল-ফিলড রেডিয়েটর
এই ধরনের হিটার ভেতরের তেল গরম করে ধীরে ধীরে ঘরে তাপ ছড়ায়।
> শব্দহীনভাবে চলে
> বন্ধ করার পরও কিছু সময় উষ্ণতা ধরে রাখে
> বাতাসের অক্সিজেন কমায় না
> ঘর গরম হতে সময় লাগে (১৫–২০ মিনিট)
কনভেকশন হিটার
বাতাস গরম করে ওপরে উঠতে সাহায্য করে, ফলে স্বাভাবিকভাবে তাপ ছড়িয়ে পড়ে।
> আকারে ছোট
> সহজে বহনযোগ্য
> ছোট ও বন্ধ ঘরের জন্য বেশি কার্যকর
কোয়ার্টজ হিটার
দ্রুত গরম হয় এবং তাৎক্ষণিক তাপ দেয়।
> বাথরুম বা স্টাডি রুমে উপযোগী
> দিকনির্দেশিত তাপ দেয়—পুরো ঘর সমানভাবে গরম হয় না
হ্যালোজেন হিটার
কোয়ার্টজের মতো কাজ করে, অনেক সময় দোলানোর সুবিধা থাকে।
> তুলনামূলক কম বিদ্যুৎ খরচ
> বাতাস গরম না করে সরাসরি তাপ দেয়
সিরামিক হিটার
সিরামিক রড ও ফ্যান ব্যবহার করে দ্রুত এবং সমানভাবে ঘর গরম করে।
> তুলনামূলক নিরাপদ
> তাপ ধরে রাখে
ফ্যান হিটার বা ব্লোয়ার
সবচেয়ে প্রচলিত ও কম দামের হিটার।
> দ্রুত গরম করে
> শব্দ বেশি
> বাতাস শুষ্ক করে, যা ত্বক ও শ্বাসযন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে
হিটার কেনার আগে নিজের প্রয়োজন বুঝুন
সব হিটার সব ঘরের জন্য উপযোগী নয়।
১০×১০ ফুটের ছোট ঘরের জন্য যে হিটার যথেষ্ট, ১৫×২০ ফুটের ঘরে তা কার্যকর নাও হতে পারে।
ঘরের আয়তন ছাড়াও বিবেচনায় রাখতে হবে—
> জানালার সংখ্যা
> ছাদের উচ্চতা
> ঘরের অবস্থান ও বাতাস চলাচল
হিটার সব সময় আসবাব, পর্দা বা বিছানা থেকে অন্তত ২ ফুট দূরে রাখতে হবে। ছোট ও ভরাট ঘরে নিরাপদভাবে বসানোর জায়গা আছে কি না, সেটিও গুরুত্বপূর্ণ।
সঠিক ওয়াটেজ নির্বাচন করুন
রুম হিটারের ওয়াটেজ সাধারণত ৪০০ থেকে ২০০০ ওয়াট পর্যন্ত হয়ে থাকে।
সহজ নিয়ম—
প্রতি বর্গফুটে প্রায় ১০ ওয়াট। যেমন— ১৫০ বর্গফুটের ঘরের জন্য প্রয়োজন প্রায় ১৫০০ ওয়াট।
তবে ছাদের উচ্চতা, ইনসুলেশন, জানালার আকার ও এলাকার আবহাওয়া অনুযায়ী এই হিসাব কিছুটা বদলাতে পারে। মনে রাখবেন— সবচেয়ে বেশি ওয়াটেজ মানেই সেরা নয়। ছোট ঘরে অতিরিক্ত ওয়াটেজ অপ্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ খরচ ও অস্বস্তি বাড়ায়।
নিরাপত্তা যেন উপেক্ষিত না হয়
রুম হিটারের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
> টিপ-ওভার প্রোটেকশন: উল্টে গেলে নিজে থেকেই বন্ধ
> ওভারহিট প্রোটেকশন: অতিরিক্ত গরম হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ
> কুল-টাচ বডি: হাত লাগলেও পোড়া লাগার ঝুঁকি কম
> সেফটি গ্রিল: আঙুল ঢুকে যাওয়ার ঝুঁকি নেই
> চওড়া ও ভারী বেস: সহজে উল্টে যায় না
> আইএসআই সার্টিফিকেশন: নিরাপত্তা মানদণ্ড নিশ্চিত করে
বিদ্যুৎ সাশ্রয় ও এনার্জি এফিশিয়েন্সি
রুম হিটার প্রচুর বিদ্যুৎ খরচ করে, বিশেষ করে প্রতিদিন দীর্ঘ সময় চালালে।
> বেশি BEE রেটিং = কম বিদ্যুৎ খরচ
> থার্মোস্ট্যাট: প্রয়োজন অনুযায়ী তাপ নিয়ন্ত্রণ
> ইকো মোড: কম ওয়াটেজে আরামদায়ক উষ্ণতা
> টাইমার: অপ্রয়োজনীয় চালু থাকা রোধ করে
সাধারণভাবে, অয়েল-ফিলড ও সিরামিক হিটার তুলনামূলক বেশি বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী।
স্বাস্থ্য ও আরামের দিকটি ভুলবেন না
কিছু হিটার বাতাস শুষ্ক করে ও অক্সিজেন কমিয়ে দিতে পারে। এর ফলে—
> শুষ্ক ত্বক
> চোখ জ্বালা
> শ্বাসকষ্টের সমস্যা হতে পারে
> হাঁপানি বা শ্বাসকষ্টের রোগীদের জন্য অয়েল-ফিলড ও সিরামিক হিটার ভালো
> শিশু ও বয়স্কদের জন্য মৃদু ও স্থির তাপ দেওয়া হিটার নিরাপদ
শব্দের মাত্রাও গুরুত্বপূর্ণ
বিশেষ করে শোবার ঘর বা অফিসের জন্য।
> অয়েল-ফিলড হিটার: প্রায় শব্দহীন
> কনভেকশন হিটার: খুব হালকা শব্দ
> ফ্যান/সিরামিক হিটার: তুলনামূলক বেশি শব্দ
৪০ ডেসিবেলের নিচে শব্দ হলে সেটিকে সাধারণত শান্ত ধরা হয়।
বহনযোগ্যতা ও সংরক্ষণ
> একাধিক ঘরে ব্যবহার করতে চাইলে হালকা ও হ্যান্ডেলযুক্ত হিটার সুবিধাজনক।
> অয়েল-ফিলড রেডিয়েটরে সাধারণত চাকা থাকে।
> ছোট হিটার সংরক্ষণ সহজ হলেও বড় ঘর গরমে কার্যকারিতা কম হতে পারে।
সঠিক রুম হিটার বেছে নিতে হলে ঘরের আয়তন, ওয়াটেজ, নিরাপত্তা, বিদ্যুৎ সাশ্রয়, স্বাস্থ্যঝুঁকি ও শব্দ— সবকিছু একসঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। সব ঘরের জন্য এক ধরনের হিটার উপযুক্ত নয়। নিরাপত্তা ও সঠিক ক্ষমতাই হোক প্রথম অগ্রাধিকার। সঠিক সিদ্ধান্ত নিলে বিদ্যুৎ বিল বা দুর্ঘটনার ভয় ছাড়াই শীতের দিনগুলো উষ্ণ, আরামদায়ক ও নিশ্চিন্তে কাটবে।
মন্তব্য (০)