নিউজ ডেস্কঃ চীন-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তির প্রাক্কালে দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া, সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান ও উন্নয়ন সহযোগিতা এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে বলে মন্তব্য করেছেন চীনের রাষ্ট্রীয় পরিষদের ওভারসিজ চাইনিজ অ্যাফেয়ার্স অফিসের মন্ত্রী চেন সু।
তিনি বলেন, চীনের সদ্য অনুমোদিত ১৫তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা আগামী পাঁচ বছরের উন্নয়ন পথনকশা নির্ধারণ করবে, যা বাংলাদেশের জন্যও অর্থনীতি, প্রযুক্তি, অবকাঠামো ও শিল্পখাতে নতুন সহযোগিতার দুয়ার খুলে দেবে।
সোমবার ঢাকার আপন ফ্রেন্ডশিপ এক্সচেঞ্জ সেন্টারের কার্যালয়ে ‘চীনের পঞ্চদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সুযোগ ভাগাভাগি করে নিতে চীন ও বাংলাদেশের যৌথ উন্নয়নের প্রচারণা’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে চীনা মন্ত্রী এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানটির সার্বিক তত্ত্বাবধান করে ঢাকাস্থ চীনা দূতাবাস এবং সহ-আয়োজক ছিল চায়না মিডিয়া গ্রুপের সেন্টার ফর এশিয়ান অ্যান্ড আফ্রিকান ল্যাংগুয়েজ প্রোগ্রাম।
চেন সু বলেন, ‘চীন ও বাংলাদেশ গ্লোবাল সাউথ-এর শক্তিশালী অংশীদার। বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রায় চীনের বিনিয়োগ, অবকাঠামো নির্মাণ, প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং শিল্পায়নকে আমরা দীর্ঘদিন ধরে সমর্থন করে আসছি। ভবিষ্যতে এ সহযোগিতা আরও গভীর হবে।’
তিনি মিডিয়া, ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের আরও বেশি চীন সফর এবং জ্বালানি অবকাঠামো, ডিজিটাল ও সবুজ অর্থনীতি খাতে যৌথ উদ্যোগ বাড়ানোর লক্ষ্যে আন্তঃদেশীয় সহযোগিতা বৃদ্ধির আহ্বান জানান।
মন্ত্রী জানান, বাংলাদেশে চীনা প্রবাসীরা দুই দেশের সম্পর্কের ‘সোনালী সেতু’। তাদের উদ্যোগের মাধ্যমেই টেক্সটাইল, গার্মেন্টস ও বিভিন্ন হালকা শিল্প বাংলাদেশে ভিত্তি পেয়েছে, যা দেশের অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানে বড় অবদান রাখছে।
মন্ত্রী আরও বলেন, চীনা প্রবাসী উদ্যোক্তারা চীনের প্রস্তাবিত গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভের লক্ষ্য বাস্তবায়নে সক্রিয় অংশগ্রহণ করছেন।
সম্প্রতি চীনা কমিউনিস্ট পার্টির অধিবেশনে ১৫তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুমোদন দিয়েছে। এটি আগামী পাঁচ বছর চীনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের বৃহৎ রূপরেখা হিসেবে কাজ করবে। এ তথ্য জানিয়ে চেন সু বলেন, পরিকল্পনাটি চীন ও বিশ্বের অন্যান্য দেশের, বিশেষ করে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে ‘উইন-উইন’ সহযোগিতার সুযোগ বাড়াবে।
প্রেসিডেন্ট সি চিনপিংকে উদ্ধৃত করে চীনা মন্ত্রী বলেন, ‘চীনের সঙ্গে হাঁটা মানে সুযোগের সঙ্গে হাঁটা, চীনের ওপর বিশ্বাস মানে আগামী দিনের ওপর বিশ্বাস এবং চীনে বিনিয়োগ মানে ভবিষ্যতে বিনিয়োগ।’
২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে স্থাপিত একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান আপন ফ্রেন্ডশিপ এক্সচেঞ্জ সেন্টারের ভাইস প্রেসিডেন্ট জাহাঙ্গীর আলম রানা জানান, সম্প্রতি চীনে ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল প্যাভিলিয়ন’ স্থাপনের অনুমোদন পাওয়া গেছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের কৃষিপণ্য, পোশাক, হস্তশিল্প, আইটি সেবা ও সম্ভাবনাময় অন্যান্য পণ্য চীনের বিশাল বাজারে আরও কাঠামোবদ্ধভাবে প্রবেশের সুযোগ পাবে।
সেমিনারে জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) বাংলাদেশ প্রতিনিধি শি চিয়াওছুন বলেন, চীনের কৃষি আধুনিকীকরণ, ডিজিটাল চাষাবাদ ও জলবায়ু-সহনশীল উৎপাদন পদ্ধতি বাংলাদেশে কৃষি রূপান্তরকে ত্বরান্বিত করতে পারে।
তিনি উল্লেখ করেন, ‘ওয়ান কান্ট্রি ওয়ান প্রায়োরিটি প্রোডাক্ট (ওসিওপি)’ প্রকল্প ইতোমধ্যে বাংলাদেশে বিশেষ কৃষি পণ্যের উৎপাদন ও বাজার সম্প্রসারণে নতুন দিগন্ত সৃষ্টি করেছে।
চাইনিজ এন্টারপ্রাইজ অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট হান খুন বলেন, চীনের ১৫তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন চীন-বাংলাদেশ শিল্প সহযোগিতাকে নতুন গতিতে এগিয়ে নেবে। অবকাঠামো, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, আধুনিক উৎপাদন ও প্রযুক্তিখাতে চীনা বিনিয়োগ আরও বাড়বে।
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক মাহবুব মোর্শেদ বলেন, ‘চীনের নজিরবিহীন উন্নয়ন বিশ্বকে বিস্মিত করছে। চীন নিজের ভবিষ্যৎ দেখেছিল। দেশটি চেয়েছিল এই ভবিষ্যতের সঙ্গে সমগ্র বিশ্বকে যুক্ত করতে। আজ বাংলাদেশে বসেও আমরাও সেই ভবিষ্যতের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করতে চাই। আমি বিশ্বাস করি, চীনের উন্নয়ন পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন পদ্ধতি আমাদের জন্য অত্যন্ত শিক্ষণীয় হতে পারে।’
বিজিএমইএ প্রেসিডেন্ট মাহমুদ হাসান খান বলেন, চীনের প্রযুক্তি ও দক্ষতা ব্যবহার করে বাংলাদেশ সিনথেটিক ও ফাংশনাল টেক্সটাইল উৎপাদনে বিশ্ব প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যেতে পারবে। এলডিসি উত্তরণের পরও চীনের ডিউটি-ফ্রি সুবিধা বহাল রাখার অনুরোধ জানান তিনি। পাশাপাশি একটি দ্বিপক্ষীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি দ্রুত সম্পাদনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
সেমিনারে বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট ফজলে শামীম এহসান বলেন, চীন ও বাংলাদেশের সম্পর্ক দীর্ঘ ইতিহাসের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। প্রাচীন সিল্ক রোড থেকে শুরু করে আজকের যুগান্তকারী অবকাঠামো প্রকল্পগুলো-পদ্মা ব্রিজ, রেল লিংক, কর্ণফুলী টানেল, পায়রা পাওয়ার প্ল্যান্ট-এসবই দুই দেশের বিশ্বাস ও সহযোগিতার প্রতীক।
তিনি বলেন, চীনের ১৫তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা নতুন সুযোগ নিয়ে এসেছে। উচ্চমানের উন্নয়ন, সবুজ প্রযুক্তি, উদ্ভাবন, ডিজিটাল রূপান্তর এবং বৈশ্বিক সংযোগের ওপর জোর দিয়ে এই পরিকল্পনা দুই দেশের জন্য যৌথ সহযোগিতার পথ খুলেছে।
চীনের রাষ্ট্রীয় পরিষদের ওভারসিজ চাইনিজ অ্যাফেয়ার্স অফিসের মন্ত্রী চেন সু’র ঢাকা সফর দুই দেশের ক্রমবর্ধমান বন্ধুত্বের শক্ত প্রমাণ উল্লেখ করে চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মাহবুব উজ জামান বলেন, চীনের উদ্ভাবন নির্ভর উন্নয়ন কৌশল ও সামাজিক কল্যাণমুখী নীতি বাংলাদেশের জন্য শিক্ষণীয়। বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের মাধ্যমে বাংলাদেশের অবকাঠামো, শিল্পায়ন ও রপ্তানি বৈচিত্র্যে আরও অগ্রগতি সম্ভব।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেন, চীনের ১৫তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা শুধু চীনের আধুনিকায়ন অগ্রযাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ নয়, এটি বৈশ্বিক উন্নয়ন সহযোগীদের জন্যও নতুন সুযোগ তৈরি করেছে।
তিনি জানান, এই পরিকল্পনা চীন-বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সহযোগিতার জন্যও নতুন দরজা খুলে দেবে। আগামী বছর ১৫তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার প্রথম বছর এবং বাংলাদেশ বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগে যোগদানের দশম বর্ষপূর্তি-যা দুই দেশের সহযোগিতাকে নতুন উচ্চতায় নেওয়ার ঐতিহাসিক সুযোগ। প্রযুক্তি হস্তান্তর, অবকাঠামো, আধুনিক কৃষি, উন্নত উৎপাদন, ডিজিটাল অর্থনীতিসহ বিভিন্ন খাতে শিল্প সমন্বয় ও সক্ষমতা বাড়াতে চীন প্রস্তুত।
দারিদ্র্য হ্রাস, গ্রামীণ উন্নয়ন ও শিল্পায়নের অভিজ্ঞতাও বাংলাদেশের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন তিনি। রাষ্ট্রদূত আশা প্রকাশ করেন-যৌথ প্রচেষ্টায় চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক আরও উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাবে এবং দুই দেশ মিলিতভাবে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির নতুন অধ্যায় রচনা করবে।
সেমিনারে আরও উপস্থিত ছিলেন চীনের শান্তিপূর্ণ পুনর্মিলন প্রচারের বাংলাদেশ বিষয়ক পরিষদের এক্সিকিউটিভ প্রেসিডেন্ট চাং ছিং বিন, ওভারসিজ চাইনিজ অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট কান চিয়া পিং ও চাও শি বো, বাংলাদেশ চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট মো. খোরশেদ আলম, বাংলাদেশ চায়না ফ্রেন্ডশিপ সেন্টারের প্রেসিডেন্ট আ স ম কামাল উদ্দিন, ভাইস প্রেসিডেন্ট মিজানুর রহমান, বাংলাদেশে জাতিসংঘ বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির যোগাযোগ প্রধান লিখুন এবং ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সভাপতি দৌলত আক্তার মালা প্রমুখ।
মন্তব্য (০)