
নিউজ ডেস্কঃ চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন নদী থেকে ৩০১ জনের মরদেহ উদ্ধার করেছে নৌপুলিশ। এসব মরদেহের ৩০ শতাংশের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। পুলিশের তথ্যমতে, প্রতি মাসে নদী থেকে গড়ে ৪৩টি মরদেহ উদ্ধার হচ্ছে। নদীতে এতো মরদেহ পাওয়ার কারণ হিসেবে আইনজীবী ও অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, শাস্তি থেকে বাঁচার জন্যই হত্যার পর মরদেহ গুম করার জন্য নদীকে বেছে নিচ্ছে অপরাধীরা।
গত ২৩ আগস্ট ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের মীরেরবাগ ঘাট থেকে এক নারী ও শিশুর মরদেহ উদ্ধার করে নৌ-পুলিশ। নারীর গলায় কাপড় প্যাঁচানো ছিলো আর শিশুর গলায় ওড়না বাধা ছিলো। একই দিনে কালিন্দি ইউনিয়নের মাদারীপুর ঘাট থেকে তরুণ-তরুণীর হাত বাঁধা মরদেহ উদ্ধার করা হয়। প্রায় ১৫ দিনেও তাদের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। মিটফোর্ড হাসপাতালের মর্গে সেই মরদেহ পড়ে আছে।
২২ আগস্টে অফিসে যাওয়ার কথা বলে বেরিয়ে এক দিন আগে নিখোঁজ সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকার। প্রায় ১৮ ঘণ্টা পর তার লাশ মুন্সীগঞ্জের মেঘনা নদী থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। তার মৃত্যুর সঠিক কারণ এখনো জানা যায়নি। ৩১ আগস্ট খুলনার সাংবাদিক ওয়াহিদুজ্জামান বুলুর মরদেহ রূপসার সেতুর নিচ থেকে উদ্ধার করে পুলিশ।
৩ সেপ্টেম্বর পটুয়াখালীর লোহালিয়া নদী থেকে রেজাউল ও তুহিন হাওলাদার নামের দুই যুবকের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। সারাদেশের প্রায় নদীতে প্রতিদিন দুইটি একটি করে মরদেহ পাওয়া যাচ্ছে। যাতায়াত ও বাণিজ্যের জন্য নিরাপদ নদী হয়ে গেছে খুনিদের লাশ গুম করার নিরাপদ পথ।
নৌ পুলিশের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালে নদী থেকে ৪৪০টি মরদেহ উদ্ধার হয়। ২৯৯টি লাশের পরিচয় শনাক্ত করা গেছে। শনাক্ত করা যায়নি ১৪১ জনের মরদেহ। অর্থাৎ উদ্ধার হওয়া মরদেহের ৩১ শতাংশের পরিচয় শনাক্ত করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
আর ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত দেশের নদী থেকে ৩০১ জনের মরদেহ উদ্ধার করে নৌ পুলিশ। এর মধ্যে ২০৯ জনের মরদেহ শনাক্ত করা গেলেও ৯২ জনের পরিচয় জানা যায়নি। উদ্ধার হওয়া ৬১ জন পুরুষ, নারী ২৪ আর শিশু ৭ জন। অর্থাৎ ৩০ শতাংশ মরদেহ পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। বেশিরভাগ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে।
সারা দেশে নদী এলাকা থেকে মরদেহ উদ্ধারের সংখ্যা বাড়ার কারণ হিসেবে অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, ‘সংঘবদ্ধ অপরাধ হত্যাকারীর চক্র বাড়ছে। প্রমাণ মুছে ফেলতে মরদেহ নদীতে ফেলে দিচ্ছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিশ্লেষক ও শিক্ষক তৌহিদুল হক বলেন, ‘আইনের চোখ থেকে সে বিরত থাকতে পারবে। সেজন্য কয়েকটি পথ সে বেছে নেয়। প্রথম হচ্ছে, নদী। অপরাধীদের বেনিফিট হলো একটা মরদেহ যদি শনাক্ত করা না যায় তাহলে সেটি বেওয়ারিশ মরদেহ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। বাসে বা কোনো পরিবহনে এসে যেখান থেকে মরদেহ সরাসরি ফেলে দেয়া যায়, সাধারণত গভীর রাতেই এটা ফেলে দেয়া হয়, এ জায়গাগুলো সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা দরকার।’
ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তথ্য প্রমাণের অভাবে এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করাই কঠিন হয়ে পড়ে।
সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী এস এম শাজাহান বলেন, ‘যদি নদীতে স্রোত থাকে তাহলে মরদেহ ভেসে যাবে, এর আর কোনে হদিস থাকবে না। আর যদি পাওয় যায়ও সেক্ষেত্রে মরদেহ ৪ থেকে ৫ দিন পর ডিকম্পোজড হয়ে যায়। তখন মৃত্যুর কারণ বের করা যায় না। এতে করে কেউ খুন করলো আর এটার সাক্ষী রাখলো না, কোন প্রমাণ রাখলো না। এটাও অপরাধ। ৩০২ এর সাথে ২০১ ও হয়। ৩০২ হলো যদি আপনি কাউকে খুন করেন।’
তবে সব ধরণের অপরাধ প্রতিরোধে অন্তর্বর্তী সরকার পদক্ষেপ নিচ্ছে বলে জানান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ‘গত কয়েকদিনের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা একটু খারাপের দিকে গিয়েছে। এটাকে আমরা আবার যেন আগের দিকে নিয়ে আসতে পারি এ ব্যবস্থা করা হবে। অপকর্ম করছে, তাদের আমরা আবার আইনের আওতায়ও নিয়ে আসছি।’
চলতি বছর প্রতি মাসে নৌ পুলিশ গড়ে ৪৩টি মরদেহ উদ্ধার করেছে। গত বছর প্রতি মাসে ৩৬টি মরদেহ উদ্ধার হয়েছে বলে পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যে ওঠে এসেছে।
মন্তব্য (০)