
পাবনা প্রতিনিধিঃ দিন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই এগিয়ে আসছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এরই মধ্যেই পাবনা-৩ আসনে (চাটমোহর-ভাঙ্গুড়া-ফরিদপুর) মনোনয়ন প্রত্যাশীরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এই আসনের সাধারণ ভোটার ও দলীয় নেতাকর্মীরা আশায় বুক বাঁধছেন। দুই যুগ ধরে বিএনপির হাত ছাড়া এই আসন পুনরুদ্ধার হবে। একইসাথে এমপি বঞ্ছিত চাটমোহরের মানুষ। সবার প্রত্যাশাও রয়েছে এবার চাটমোহর থেকে বিএনপির প্রার্থী দেওয়া হবে।
কিন্তু হঠাৎ করেই কেন্দ্রীয় কৃষকদলের সভাপতি কৃষিবিদ হাসান জাফির তুহিনের একটি ফেসবুক পোস্ট ঘিরে শুরু হয়েছে তোলপাড়। পাবনা-৩ আসনে নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে তাকে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় বিএনপি। অথচ তিনি পাবনা-২ আসনে (সুজানগর-বেড়া’র আংশিক) থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন। তার ফেসবুক পোস্ট ঘিরে বইছে আলোচনা আর সমালোচনার ঝড়। চা স্টল থেকে শুরু করে হাট বাজার সবখানে একই আলোচনা। ক্ষোভ ও হতাশা ব্যক্ত করেছেন দলীয় নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ। বিষয়টি এখন টক অব দ্য পাবনা-৩।
বৃহস্পতিবার (২৭ জুন) রাতে তার নিজের ফেসবুক পোস্টে কৃষিবিদ হাসান জাফির তুহিন লেখেন ‘প্রিয় পাবনা-২ (সুজানগর-বেড়া) এর আমার অগণিত নেতা-কর্মী, শুভাকাঙক্ষী, ভাই ও বন্ধুগণ, আসসালামু আলাইকুম। আপনাদের ভালোবাসা, সমর্থন ও আস্থার জন্য আমি চিরঋণী। ছাত্র রাজনীতির পর থেকেই আমি আমার রাজনৈতিক কর্মকান্ড আমার পৈত্রিক নিবাস পাবনা-২ আসনকে কেন্দ্র করেই করে আসছি। কিন্তু বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমাকে পাবনা-৩ (ভাঙ্গুড়া, চাটমোহর ও ফরিদপুর) আসন থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের নিমিত্তে কাজ করতে বলা হয়েছে।’
‘আমি জানি, এই সিদ্ধান্ত আপনাদের অনেককেই দারুনভাবে ব্যাথিত করবে। আপনারা আমাকে যেভাবে আগলে রেখেছেন, ভালোবেসেছেন, সমর্থন জুগিয়েছেন তা সত্যিই আমার আগামীর পথ চলার শক্তি।’
‘আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই দলের বৃহত্তর স্বার্থে নির্বাচনের আসন বদলালেও আপনাদের সাথে আমার হৃদয়ের যে সম্পর্ক তার এতটুকু ব্যত্যয় হবে না। আমি আজীবন পাবনা-২ এর গণমানুষের সাথেই ছিলাম, আছি, থাকব ইনশাআল্লাহ। এখানকার মাটি, মানুষ, নেতাকর্মী আমার আত্মার অংশ। সারাদেশের কৃষকদলের নেতাকর্মীদের মতো আমার ভালোবাসায় যুক্ত হলো পাবনা-৩ এর গণমানুষ। আমি বিশ্বাস করি, আমরা একসাথে দেশের গণতন্ত্র, উন্নয়ন এবং মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে আরও শক্তিশালী হবো। আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে গণতন্ত্রের মা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং দেশনায়ক তারেক রহমানের নির্দেশনা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার কর্মসূচি পালন করি।’
তার এই ফেসবুক পোস্টের পর থেকেই পাবনা-৩ আসনের দলীয় নেতাকর্মী আর কর্মী সমর্থকরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন দলের এমন সিদ্ধান্তে। কারণ এই আসনে সবচেয়ে বড় উপজেলা ও সবচেয়ে বেশি ভোটার চাটমোহর উপজেলায়। তাই চাটমোহরবাসীর প্রত্যাশা ছিল বিএনপি থেকে এবার চাটমোহর উপজেলার কেউ মনোনয়ন পাবেন। শুধু তাই নয়, ফরিদপুর ও ভাঙ্গুড়া উপজেলার বিএনপি নেতাবর্মীদের মধ্যেও দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে চাটমোহর পৌর শহরের চা বিক্রেতা শুক চাঁদ বলেন, ‘বাইরের কোনো প্রার্থীকে পাবনা-৩ আসনে প্রার্থী হিসেবে মানবো না। প্রয়োজনে ভোট দেব না। যারা মনোনয়ন দেবে তারাই এসে ভোট দিক। এই সিদ্ধান্ত আমরা মানি না। তিনি এতদিন চাইলেন তার নিজের পাবনা-২ আসনের মনোনয়ন। এখন হুট করেই তাকে পাবনা-৩ আসনে প্রার্থী করার কোনো মানে হয় না।’
চাটমোহর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সচিব আসাদুজ্জামান লেবু বলেন, ‘বিগত আন্দোলন সংগ্রামে চাটমোহরের নেতাকর্মীরাই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছিলেন। জেল জুলুম অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছেন। এখন হঠাৎ করে অন্য আসনের একজন নেতাকে এই আসনে প্রার্থী করা কতটুকু সমীচীন সেটি ভেবে দেখা দরকার। এমন সিদ্ধান্তে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। চাটমোহরের ত্যাগী নেতারা বারবারই অবহেলিত বঞ্ছিত থেকে যাচ্ছে। কৃষিবিদ হাসান জাফির তুহিনকে তার পাবনা-২ আসনে প্রার্থী করা যেতো। যেহেতু সময় আছে, আমরা তারেক রহমানের কাছে প্রার্থী পরিবর্তনের জোর দাবি জানাচ্ছি। তারপরও যদি তারেক রহমান তার সিদ্ধান্ত বহাল রাখেন আমরা তার পক্ষে কাজ করবো। আমরাতো দলের বাইরে নই।’
চাটমোহর উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ও পার্শ্বডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান রবিউল করিম তারেক বলেন, ‘গত বুধবার (২৬ জুন) কেন্দ্রীয় বিএনপি আমাদের পাবনা-৩ আসনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দকে ডেকেছিলেন। সেখানে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আমাদের বলেন, তারেক রহমান সাহেব নির্দেশনা দিয়েছেন কৃষকদলের সভাপতি কৃষিবিদ হাসান জাফির তুহিন সারাদেশে আন্দোলন সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। সারাদেশের কৃষকদলকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন। যেহেতু কৃষকদলের সাধারণ সম্পাদককে তার এলাকার একটি আসনে প্রার্থী করা হয়েছে সেকারণে সভাপতি কৃষিবিদ তুহিনকেও একটি আসনে প্রার্থী করতে হবে। সেকারণে তারেক রহমানের নির্দেশনায় কেন্দ্র থেকে তুহিনকে পাবনা-৩ আসনে নির্বাচনের কাজ করার জন্য বলা হয়েছে। আপনারা তার সাথে কাজ করবেন। তাকে সহযোগিতা করবেন।’
রবিউল করিম তারেক আরো বলেন, ‘বৈঠকে আমাদের কোনো মতামত জানতে চাওয়া হয়নি বা আমাদের কিছু বলারও সুযোগ ছিল না। যেহেতু বিএনপি করি, এখন যাকেই এই আসনে দল প্রার্থী দেবে আমাদের তার পক্ষেই কাজ করতে হবে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চাটমোহর উপজেলা বিএনপির সাবেক সদস্য সচিব ও পাবনা-৩ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশী হাসাদুল ইসলাম হীরা বলেন, ‘দলের সিদ্ধান্ত দেওয়ার মালিক জনাব তারেক রহমান। তিনি যখন সিদ্ধান্ত দেবেন তখন অবশ্যই সেই সিদ্ধান্ত মাথা পেতে নিতে হবে। সময় আসলে কথা হবে। তারেক রহমান দলের মালিক। তিনি আগে দেশে আসুক। তিনি যদি কোনো সিদ্ধান্ত দেন তখন সেটা অবশ্যই মানতে হবে। কৃষিবিদ হাসান জাফির যে পোস্ট দিয়েছেন সেটা দলের সিদ্ধান্ত কিনা সেটা আমি এখন বলতে পারব না। হাই কমান্ডের সিদ্ধান্ত কখন আসবে, যখন মনোনয়ন দেবে তখন আসবে। এখন তো কাউকে মনোনয়ন দেয়নি।’
এ ব্যাপারে জানতে চেয়ে পাবনা-৩ আসনের সাবেক এমপি ও উপজেলা বিএনপির সাবেক আহবায়ক কেএম আনোয়ারুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তার মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
আরেক মনোনয়ন প্রত্যাশী জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক দল কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির উপদেষ্টা ও পাবনা জেলা বিএনপির সাবেক সদস্য হাসানুল ইসলাম রাজা বলেন, ‘আামি দলের জন্য মাঠে ময়দানে কাজ করে যাচ্ছি। দল কাকে মনোনয়ন দেবে সেটা দলের সিদ্ধান্ত। আমি নির্বাচনের তফশীল হওয়ার আগ পর্যন্ত তৃণমুল মানুষের সাথে তারেক রহমানের ৩১ দফা তুলে ধরতে কাজ করে যাবো।’
এ বিষয়ে জেলা বিএনপির সদস্য সচিব ও মনোনয়ন প্রত্যাশী অ্যাডভোকেট মাকসুদুর রহমার ওরফে মাসুদ খন্দকারের মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তিনি ফোন রিসিভ না করায় বক্তব্য পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য কেন্দ্রীয় কৃষকদলের সভাপতি কৃষিবিদ হাসান জাফির তুহিন এর মুঠোফোনে (০১৭১১-১৯১৯১৯) বৃহস্পতিবার রাতে ও শুক্রবার দুপুরে কয়েকদফা যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও সাড়া মেলেনি তার।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পাবনা-৩ সংসদীয় আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ৫ লাখেরও অধিক। এরমধ্যে চাটমোহর উপজেলায় মোট ভোটার সংখ্যা তিন লাখের অধিক। আর ভাঙ্গুড়া ও ফরিদপুর উপজেলা নিয়ে মোট ভোটার সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ। এই সংসদীয় আসনে সবচেয়ে ভোটার সংখ্যা বেশি চাটমোহর উপজেলায়। দুই উপজেলা মিলিয়ে (ভাঙ্গুড়া-ফরিদপুর) যে ভোটার তার চেয়েও ৫০ হাজারেরও অধিক ভোটার চাটমোহর উপজেলায়।
মন্তব্য (০)