• শিশু সংবাদ

শিশু ফারজিনার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের স্থান হয়েছে প্রতিবেশী ঘরের ট্রাঙ্কে!

  • শিশু সংবাদ
  • ২৫ নভেম্বর, ২০২৩ ১২:৫৩:৪৪

ছবিঃ সিএনআই

সুনামগঞ্জ: সুনামগঞ্জের হাওরের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে উঠে এসে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছে শিশু ফারজিনা। রাষ্ট্রীয় পদক পাওয়ার আনন্দ থাকলেও যে পুরষ্কার এনে দিল এতো আনন্দ সেই ট্রফি, স্বর্ণপদক, ক্রেস্ট রাখার মতো ঘরই নেই তাদের। অভাবের তাড়নায়  ভিটেমাটি বিক্রি করে থাকছেন পরের ঘরে আশ্রিত হয়ে। তাই অর্জিত পুরষ্কারগুলো নিজের ঘরে রাখার সৌভাগ্য হলোনা ফারজিনার। প্রতিবেশী ঘরের ট্রাঙ্কে স্থান হয়েছে গৃহহীন ফারজিনার পুরষ্কারের। সেখানে পরম যত্নে আগলে রেখেছে ট্রফি, মেডেল সহ অন্যান্য পুরষ্কার। এখন নিজ ঘরে থেকে পড়ালেখা করে বড় হয়ে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখছে ফারজিনা ও তার পরিবার। তাদের এমন স্বপ্ন বাস্তবায়নের আশ্বাস দিয়েছে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন। 

 

সুনামগঞ্জ জেলা শহর থেকে জলে-স্থলে সাড়ে ৩ ঘন্টার দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে তাহিরপুর উপজেলার শ্রীপুর ইউনিয়নের চিলান তাহিরপুর গ্রাম। ভারতের মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে চারদিকে পানি বেষ্টিত দরিদ্র এ গ্রামেই বেড়ে উঠেছে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০২২ এর শিশু শাখায় বিশেষ পুরষ্কার জয়ী ফারজিনা। অনুন্নত যোগাযোগ আর শিক্ষা—দীক্ষার দিক থেকে পিছিয়ে পড়া হাওরপাড়ের  আরো অসংখ্য সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের মধ্যে একজন ফারজিনা।  ফারজিনার বাবা পেশায় একজন জেলে, মা গৃহিণী । অভাবের তাড়নায় বিক্রি করে দিয়েছেন নিজের ঘরবাড়ি। দীর্ঘদিন ধরে থাকছেন পরের ঘরে আশ্রিত হয়ে। 

ফারজিনার নানি সেতারা বেগম বলেন, ঘরবাড়ি বিক্রি করার পর আমার মেয়ে, জামাই, নাতি-নাতনি আমার ঘরে থাকছে। আমি ঠাঁই দিয়েছি তাদের।  মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরার পর আমি তাদের বুকে টেনে নিয়েছি। আমি তো নানি, তাদের ফেলে দিতে পারিনা। আমার নাতনির এই পুরষ্কারে আমি খুশী।

রাষ্ট্রীয় পদক পাওয়ার আনন্দ থাকলেও ঢাকা পোস্টের সাথে আলাপচারিতায় অতীতের অভাব অনটন আর দু:খ-কষ্টের কথা মনে করে মন ভারী হয়ে যায় ফারজিনার মা আফিয়া বেগমের।  বললেন তিন বেলার মধ্যে একবেলা খেয়ে দিন কাটিয়েছি। পড়ার কাপড় চোপড় ও ঠিকমতো পাইনি। ছেলে মেয়েদেরও দিতে পারিনি। আমাদের অভাবের সংসার দেখে অন্যরা কাঁদতো। এতো কষ্টের মধ্যে মেয়ের এই পুরষ্কার পাওয়া অকল্পনীয় আমাদের কাছে। 

ফারজিনার চলচ্চিত্র যুক্ত হওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া ছবির পরিচালক কাইয়ুম স্যার আমাদের গ্রামে আসেন ছবির জন্য জায়গা খোঁজতে। আমাদের গ্রামে এসে তিনি আমার মেয়েকে দেখেন। তখনই আমাকে বলেন আপনার মেয়ে আমার দরকার। আমি রাজি হলে স্যার তখন বললেন একটা ছবিতে অভিনয় করার জন্য লাগবে কিছু সময়ের জন্য। আমরা রাজি থাকায় পরে তিনি ফারজিনাকে দিয়ে অভিনয় করান। 

তারপর হঠাৎ কয়েকমাস আগে আবার স্যার ফোন দিয়ে বললেন ফারজিনার আম্মু আপনাদের মেয়ের কাগজপত্র দরকার। কাগজপত্র দিলে কিছু টাকা হয়তো পাব এই আশায় দ্রুত ইউনিয়ন অফিস থেকে তার জন্ম নিবন্ধনের কাগজ ঠিক করে স্যারের কাছে পাঠাই। এরপর স্যার আবার একদিন বললেন যে ঢাকায় আসতে হবে। তখনও জানিনা কি পুরষ্কার বা কেন যাচ্ছি। গিয়ে জানি এতো বড় অনুষ্ঠান আর প্রধানমন্ত্রী নিজে দিবেন পুরষ্কার। 

তিনি আরও বলেন, আমার মেয়েকে পড়ালেখা করাতে চাই। পড়ালেখার পাশাপাশি যদি কাইয়ুম স্যারের মতো অন্য কেউ আমার মেয়েকে নিয়ে চলচ্চিত্রে কাজ করাতে চায় তাহলে আমার মেয়ে ভবিষ্যতেও চলচ্চিত্রে কাজ করবে। 


 
ফারজিনার বাবা আবু সায়েম বলেন, গ্রামের সাধারণ পরিবারের সন্তান আমি। কখনো মাছ ধরে কখনো মৌসুমি কাজ করে সংসার চালাই। আমার জীবনে প্রধানমন্ত্রীর সামনে যাবো এটা চিন্তাও করিনাই। মেয়ে আমাকে এতো বড় সম্মানের জায়গায় নিয়ে গেল। মেয়ের কারণে অনেক বড় বড় মানুষ এখন আমাদের খোঁজ নিচ্ছেন, সহযোগিতা করছেন। মেয়েকে নিজ ঘরে পড়ালেখা করিয়ে মানুষের মতো মানুষ বানানোটাই এখন স্বপ্ন। 

 এতো সংগ্রাম আর প্রতিবন্ধকতার শিকল ভেঙে  ফারজিনা এবছর পেয়েছে চলচ্চিত্র অঙ্গনের সর্বোচ্চ সম্মান জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ‘কুড়া পক্ষীর শূনে উড়া’ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য শিশুশিল্পী শাখায় গত মঙ্গলবার (১৪ নভেম্বর) প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে  বিশেষ পুরষ্কার গ্রহন করে। তবে পুরষ্কার পেলেও সেই পুরষ্কার রাখার ঘরই নেই দেশে আলোড়ন সৃষ্টিকারী এই শিশুশিল্পীর। রাষ্ট্রীয়ভাবে পাওয়া পুরষ্কার রেখেছেন প্রতিবেশীর ঘরের ট্রাঙ্কে। পুরষ্কারের পর একটা ঘর পাওয়ার স্বপ্ন এখন তাদের। সেই ঘরে থেকে পড়ালেখা করে শিক্ষক হতে চায় ফারজিনা। 

এদিকে হাওরের পিছিয়ে পড়া জনপদের ফারজিনার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া নিয়ে হাওরপাড়ে বইছে বাঁধ ভাঙা খুশীর জোয়ার। ফারজিনাকে নিয়ে গৌরবান্বিত তারা। গৃহহীণ ফারজিনাকে একটা ঘর করে দেয়ার দাবী তাদেরও। ফারজিনার লেখাপড়ার দায়িত্ব নিয়ে জায়গা সহ ঘর নির্মাণেরও আশ্বাস দিয়েছেন সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী। 

মন্তব্য ( ০)





  • company_logo