• বিশেষ প্রতিবেদন

৪৪৪ বছর ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে তিন গম্বুজবিশিষ্ট চাটমোহরের 'শাহী মসজিদ'

  • বিশেষ প্রতিবেদন

ছবিঃ সিএনআই

 তোফাজ্জল হোসেন বাবু, পাবনা : বাংলাদেশের উত্তর অঞ্চলের পাবনা প্রাচীন ও পুরাকীর্তির জনপদ। সুলতানী-মোঘল আমলের বহু নিদর্শন পাবনা জেলায় রয়েছে। পুরোনো জেলা পাবনার বিভিন্ন উপজেলায় যে সব প্রত্নতত্ন মসজিদ ও নিদর্শনগুলো রয়েছে। তার 

মধ্যে শাহী মসজিদ অন্যতম। ৪৪৪ বছরের এই নিদর্শনটি যেন ইতিহাসে সুলতানী-মুঘল স্থাপত্যের এক অপূর্ব নিদর্শন।

আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে তিন গম্বুজবিশিষ্ট 'শাহী মসজিদ'। শাহী মসজিদটি বাংলার মুসলিম স্থাপত্যে একটি নতুন অধ্যায় সংযোজন করে। 

পাবনা-ভাঙ্গুড়া মহাসড়কে চাটমোহর শহরের ভাদু নগর মোড় থেকে দেড় কিলোমিটার উত্তরে সুলতানী মুঘল আমলের নিদর্শন নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস ঐতিহ্যের শাহী মসজিদটি।

পাবনার চাটমোহর উপজেলা সদরে ঐতিহাসিক ‘মাসুম খাঁর মসজিদ’ প্রায় সাড়ে ৪ শত বছর পূর্বে নির্মিত মাসুম খাঁ কাবলীর মসজিদটি কালের সাক্ষী হয়ে রয়েছে চাটমোহর উপজেলা পরিষদের পশ্চিমে।

অধ্যক্ষ আব্দুল হামিদ এর চলনবিলের ইতিকথা গ্রন্থ থেকে জানা যায়, সম্রাট আকবরের শাসনামলে সৈয়দ নেতা আবুল ফতে মোহাম্মদ মাসুম খাঁর অর্থায়নে তারই সহোদর খাঁন মুহাম্মদ তুকি খান ৯৮৯ হিজরি অর্থাৎ ১৫৮১ খ্রিষ্টাব্দে চাটমোহরে মাসুম খাঁর মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল। 

সৈয়দ আবুল ফতে মোহাম্মদ মাসুম খাঁর সম্বন্ধে জানা যায়, তিনি দিল্লীর সম্রাট আকবরের অধীনে ৫ হাজার সৈন্যের অধিনায়ক ছিলেন। তার পূর্ব পুরুষ সুলতান হুসেন শাহের রাজত্ব কালে আফগানিন্তানের রাজধানী কাবুল হতে এসেছিলেন। শিলালিপি পাঠ, অনুযায়ী অনুমান করা যায়, মাসুম খাঁন নিজেকে সুলতানরূপে ঘোষণা করেন। তিনি নিজে এই উপাধি গ্রহণ করেন। কিছুকালের জন্য পাবনা অঞ্চলে স্বাধীন সালতানাত প্রতিষ্ঠা করেন এবং চাটমোহরে রাজধানী স্থাপন করেন। পরবর্তী সময়ে চাটমোহরে বসতি স্থাপন করেন। 

১৫৫৫ খ্রিষ্টাব্দে এখানেই সৈয়দ আবুল ফতে মোহাম্মদ মাসুম খাঁর জন্ম। তার পূর্ব পুরুষরা খোরাসানের তুরাবর্তী বংশের কাকশাল গোত্রের সৈয়দ ছিলেন। মাসুম খাঁর চাচা আজিজ মোহাম্মদ মাসুম খাঁ ২০ বছর বয়সে ১৫৭৫ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট আকবরের সৈন্য দলে যোগদান করেন। 

যুবক মাসুম খাঁ কালা পাহাড় নামক শত্রু সৈন্যের অধিনায়ককে যুদ্ধে পরাজিত করে স্বীয় দক্ষতার গুণে পাঁচ হাজারী মনসবদার পদে উন্নীত হন। 

ইসলাম ধর্মের উপর সম্রাট আকবরের নিষ্ঠা ছিল না মনে করে কাকশাল গোত্র ও বাংলার বারো ভূঁইয়ারা বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ১৫৭৯ সালে মাসুম খাঁ বারো ভূঁইয়াদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষনা করেন। চাকুরী ছেড়ে দিয়ে বারো

ভূঁইয়াদের দলে যোগদান করেন। কিন্তু সম্রাট আকবরের প্রধান সেনাপতি ও গভর্ণর শাহবাজ খাঁনের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তিনি শীতলক্ষ্যার তীরে ভাওয়ালের গভীর অরণ্যে আত্মগোপন করেন। সেখানেই বাদশাহী ফৌজের সঙ্গে পুনঃযুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ সময় ৪৪ বছর বয়সে ১৫৯৯ খ্রিষ্টাব্দে ফৌজি বাহিনীর হাতে নির্মম ভাবে মৃত্যুবরণ করেন মাসুম খাঁ। সৈয়দ আবুল ফতে মোহাম্মদ মাসুম খাঁ সম্রাট আকবরের অধীনতা অস্বীকার করে চাটমোহর 

স্বাধীন ক্ষমতা পরিচালনাকালীন সময়ে এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। তখন থেকেই মসজিদটি মাসুম খাঁর মসজিদ নামে পরিচিত। ঐ সময় বড়াল নদী পথে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো থাকায় চাটমোহর প্রসিদ্ধ স্থান রুপে গণ্য ছিল। এখানে কাবলী, কাজী, খন্দকার, পাঠান, আফ্রিদিসহ বিভিন্ন গোত্রের বসবাস ছিল। গোত্রীয় অনুসারে এখনও চাটমোহর পৌরসভার মধ্যে পাঠানপাড়া (বর্তমান জিরোপয়েন্ট), আফ্রাতপাড়া নামে দু’টি পাড়া-মহল্লা বিদ্যামান রয়েছে। 

এক সময় প্রমত্তা বড়াল নদীর দক্ষিণ পাশে চাটমোহর থানা অবস্থিত ছিল এবং প্রাচীন বাণিজ্য কেন্দ্র ও পাঠান ভূমি হিসাবে প্রসিদ্ধ লাভ করে। ৪৫ ফুট দীর্ঘ ২২ ফুট ৬ ইঞ্চি চওড়া এবং ৪৫ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট মাসুম খাঁ কাবলীর মসজিদটি আজও মুসলমানরা সৃষ্টিকর্তার দরবারে তাদের ফরিয়াদ জানিয়ে আসছে। ক্ষুদ্র পাতলা জাফরী ইটে মসজিদটি নির্মিত। এর দেয়ালে ৬ ফুট ৯ ইঞ্চি প্রশস্ত। ৩টি প্রবেশ পথের সঙ্গে মিল রেখে পশ্চিম দেয়ালে রয়েছে মোট তিনটি মিহরাব। কেন্দ্রীয় মিহরাব থেকে দুই পাশের মিহরাবে রয়েছে বড় সুরঙ্গের মতো অপূর্ব নিদর্শন।

দেয়ালের গায়ে প্রাচীন ভাস্কর্য শিল্পের নিদর্শন এখনো দেখা যায়, চার শ’ ৪৪ বছর পূর্বে নির্মিত এ মসজিদটির তিনটি গম্বুজ ও ছাদ প্রায় ধ্বংস হয়ে পড়েছিল। দেয়ালের ইট খসে যখন পুরোনো নিদর্শন আর ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছিলো, ঠিক সেসময় ১৯৮০'র দশকে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত

অধিদফতর সম্পূর্ণরূপে সংস্কার করে মসজিদটি। বর্তমানে এটি সংরক্ষিত মসজিদ। “লা-ইলাহা-ইল্লালাহু-মুহাম্মাদুর-রাসূলূল্লাহ” এবং 'কালেমা শাহাদাৎ' লেখা খন্ডিত একখানা কালো পাথর মসজিদের সামনের ভাগে স্থাপন করা রয়েছে। মিঠা পানির একটি ইঁদারা ছিল মসজিদটি সামনে। 

বর্তমানে ইঁদারাটি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ইঁদারার মুখ ঢালাই করে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ১৯০৪ সালে প্রাচীন কীর্তি রক্ষা আইনের তদানীন্তন পাকিন্তান সরকার মসজিদটি রক্ষার চেষ্টা করেন। মসজিদটি নির্মাণের ইতিহাস সম্বলিত এক খন্ড কৃষ্ণপাথরের একপাশে ফার্সি ভাষা এবং অপর পাশে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবের মুর্তি অংকিত ছিল। স্থানীয়দের ধারণা এই মসজিদের পাশে অতীতে হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির ছিল। সে পাথর বর্তমানে রাজশাহী বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়ামে রক্ষিত আছে। মাসুম খাঁ কাবলীর মসজিদের পাশে অতীতে একটি নগর রক্ষিদের কয়েকটি পাহারা ঘর (চৌকি) ছিল বলে জানা যায়। বর্তমানে সে পাহাড়া চৌকিগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। দখল হয়ে গেছে

ওই স্থানগুলো। পরবর্তীতে সরকারীভাবে মসজিদটি সংস্কার করে সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রাচীর-গেট তৈরী করে পরিবেশে আনা হয়েছে মাধুর্য্য। নির্মাণ করা হয়েছে মিনার।

মসজিদটির সৌন্দর্য্য এখনও মানুষকে বিমোহিত করে। বহু পর্যটক আসেন সম্রাট আকবরের স্মৃতি বিজরিত প্রায় সাড়ে ৪ শত বছরের মাসুম খাঁ কাবলীর (শাহী মসজিদ) মসজিদটি দেখতে। যা এখনো চোখ ধাঁধিয়ে 

দেয়, ঈদ-উল ফিতর ও ঈদ-উল আযহা’র ঈদের দু’টি জামাত এখানে অনুষ্ঠিত হয়। দূর থেকে মসজিদটি বিশাল মনে হলেও ভেতরে মাত্র দুই কাতার লোক নামাজে দাঁড়াতে পারে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ও জুমার নামাজ আদায় হয় এই মসজিদে। এছাড়া মসজিদের বাইরে দুটি ঈদের নামাজের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। 

মন্তব্য (০)





image

রাণীনগরের পাখি পল্লী পর্যটন এলাকায় নির্মাণ হচ্ছে দৃষ্টিনন...

নওগাঁ প্রতিনিধি: নওগাঁর পর্যটন এলাকাগুলোর মধ্যে অন্যতম জেলার...

image

শ্রীপুরে পানি বন্দি কয়েক হাজার পরিবারের মানবেতর জীবনযাপন

শ্রীপুর (গাজীপুর) প্রতিনিধি : গাজীপুরের শ্রীপুরে টানা বর্ষণের ফলে বৃষ্টি...

image

ওমরাহ পালনে মানতে হবে নতুন ১০ নিয়মকানুন

নিউজ ডেস্ক : লাখ লাখ মুসলমানের কাছে ওমরাহ পালন সবসময়ই একটি স্বপ্ন। কিন্...

image

পাইকগাছায় অপসিজেন তরমুজ ও সামমাম চাষে সবুজ বিপ্লব

শাহরিয়ার কবির, পাইকগাছা (খুলনা

image

ফ্যাসিবাদের অবসানে ভোটযুদ্ধে বিএনপি জামায়াতের মাঝে হবে কো...

গাইবান্ধা প্রতিনিধিঃ ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কে সা...

  • company_logo