• শিক্ষা

কারিগরি শিক্ষা কার্যক্রম বহুমুখী সংকটে আছে

  • শিক্ষা
  • ১৬ আগস্ট, ২০২০ ১১:৩৫:৫২

ফাইল ছবি

নিউজ ডেস্কঃ সরকার দক্ষতাভিত্তিক কর্মমুখী শিক্ষায় গুরুত্ব দিলেও সেই তুলনায় দেশের কারিগরি শিক্ষায় ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদের ঝোঁক বাড়ছে না। ছয় বছর আগে এই ধারায় শিক্ষার্থী ছিল সোয়া ৯ লাখ, আর বর্তমানে ১১ লাখ ১৭৭ জন। এই শিক্ষা কার্যক্রম বহুমুখী সংকটে থাকায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। কারিগরি শিক্ষার বিভিন্ন ধারায় বর্তমানে ভর্তির আবেদন নেয়া হচ্ছে। কিন্তু এ শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরতে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো প্রচার নেই। ফলে আশানুরূপ সাড়া মেলেনি। শুক্রবার পর্যন্ত ছয় দিনে মাত্র ১ লাখ তিন হাজার শিক্ষার্থী আবেদন করেছে। এ অবস্থায় চলতি বছরও শত শত আসন শিক্ষার্থীশূন্য থাকার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, মূলত কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ছাড়াই চলছে এ শিক্ষা। কোর্স-কারিকুলামও মান্ধাতা আমলের। প্রায় ৪ দশক আগে চালু করা কারিকুলাম অনুসরণ করা হচ্ছে পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের শিক্ষায়। কারিগরি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক সংকট প্রকট। শিক্ষকদের নেই প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় ল্যাবরেটরি-গবেষণাগার নেই। এ শিক্ষার উন্নয়নে কেন্দ্র থেকে শুরু করে স্থানীয় পর্যায় পর্যন্ত কোনো তদারকির ব্যবস্থা নেই। নীতিনির্ধারণী বিভিন্ন পদে আসীন আছেন অপ্রকৌশলী কর্মকর্তা। শিক্ষার নামে বাণিজ্য, নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাটের অভিযোগ আছে কমবেশি। ফলে কারিগরি শিক্ষা খাতে সার্বিকভাবে তৈরি হয়েছে বিশৃঙ্খলা। এ কারণে সচেতন অভিভাবকরা তাদের সন্তানকে পাঠাচ্ছেন না এই শিক্ষায়। এদিকে বিদ্যমান এই পরিস্থিতির মধ্যে নতুন সংকট নিয়ে এসেছে এ বছরের ভর্তি নীতিমালা। এতদিন বেসরকারি ৫১১ পলিটেকনিকে ১০ বছর আগে আর সরকারি ১১০ প্রতিষ্ঠানে পলিটেকনিক ও টিএসসিতে তিন বছর আগে এসএসসি পাস শিক্ষার্থীরা ভর্তি হতে পারত। এ বছর পাসের বা বয়সের এই বিধিনিষেধ তুলে দেয়া হয়েছে। মূলত ভর্তি বৃদ্ধি ও বিদেশ ফেরত কর্মীদের শিক্ষার সুযোগ দিতে এই ব্যবস্থা করেছে সরকার। কিন্তু এতে শিক্ষায় ভারসাম্য নষ্ট, অপরাজনীতির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান অশান্ত হওয়া এবং মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টির মাধ্যমে ঝরে পড়ার হার বৃদ্ধির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এমন পদক্ষেপের প্রতিবাদে শুক্রবার ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউট (আইডিইবি) একটি মতবিনিময় সভাও আয়োজন করে। সভা থেকে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার না করলে ৫ সেপ্টেম্বর থেকে লাগাতার আন্দোলনে নামার হুমকি দেয়া হয়েছে।

আইডিইবির সাধারণ সম্পাদক শামসুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, বর্তমানে নানান ধরনের সংকটে নিপতিত কারিগরি শিক্ষা খাত। নতুন নীতিমালায় শিক্ষার্থী ভর্তি করতে গেলে সার্বিকভাবে মূলধারার কারিগরি শিক্ষায় সংকট আরও বাড়বে। বোর্ডের আইনি অধিকার কেড়ে নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় গোঁয়ার্তুমি করে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়েছে। কারিগরি শিক্ষা ধ্বংসের গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ এটা। অস্তিত্ব রক্ষার্থে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে যা করা প্রয়োজন তারা তা করবেন।

দেশে বর্তমানে কয়েক ধরনের কারিগরি শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। এগুলোর একটি হচ্ছে ছয় শতাধিক সরকারি-বেসরকারি পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে ৩৬ বিষয়ে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং অধ্যয়ন। এছাড়া মেরিন একাডেমি, সার্ভে ইন্সটিটিউটসহ বিভিন্ন ধরনের ডিপ্লোমা কোর্স আছে। সাধারণত এই শিক্ষাকেই মূলধারার কারিগরি শিক্ষা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এছাড়া আছে শর্ট কোর্স। এটি ৩ মাস, ৬ মাস, ১ বছর মেয়াদি। সাধারণত বিদেশমুখী জনশক্তিকে এই শিক্ষা দেয়া হয়, যাতে তারা ভালো বেতনে চাকরি নিতে পারেন। দক্ষ জনশক্তির জন্য আছে সার্টিফিকেট কোর্স। ৬টি লেভেলের আরপিএল (রিকগনিশন অব প্রায়োর লার্নিং) নামে এ কোর্সের ষষ্ঠটি সম্পন্ন করলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সমান ডিগ্রি দেয়া হয়। নবম-দশম শ্রেণি এবং উচ্চ মাধ্যমিকে ভোকেশনাল শিক্ষা চালু আছে। উচ্চ মাধ্যমিকে আছে এইচএসসি বিএম (ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা)। সবমিলে এসব কোর্স ও ট্রেডে কারিগরি শিক্ষা দেয়া হয় সারা দেশে প্রায় ৯ হাজার প্রতিষ্ঠানে। এসব প্রতিষ্ঠান খোলার জন্য কমবেশি নীতিমালা আছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠান স্থাপনে সেই নীতিমালা বাস্তবায়নে দুর্নীতির অভিযোগ আছে। যে কারণে পর্যাপ্ত জায়গা, জমি, ল্যাবরেটরি ছাড়াই এক একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। ওইসব প্রতিষ্ঠানে ব্যবহারিক ক্লাসের বালাই নেই। হাতে-কলমে নয়, তাত্ত্বিকভাবে শিখছে তারা। অপরদিকে তদারকির অভাবে এসব প্রতিষ্ঠান কী পড়াচ্ছে, শিক্ষার্থীরা কী শিখছে, কত টাকা নিচ্ছে- কোনো কিছুই দেখার কেউ নেই।

আইডিইবির সভাপতি একেএমএ হামিদ কারিগরি শিক্ষায় বর্তমানে ৯টি সংকট বিরাজ করছে বলে উল্লেখ করে বলেন, কারিগরি প্রতিষ্ঠানের কোনো কোনো বিভাগে শিক্ষকই নেই। কোনোটি একমাত্র শিক্ষক দিয়ে চলছে। শিক্ষকের পাশাপাশি ওয়ার্কশপ, ল্যাবরেটরি ও ক্লাসরুম সংকট বিদ্যমান। ৩৬০ ঘণ্টার সংক্ষিপ্ত কোর্সের প্রতিষ্ঠান কারিগরি স্কুল ও কলেজ (টিএসসি)। এসব প্রতিষ্ঠানে ৪ বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা চালু করলেও একজন শিক্ষকও নিয়োগ দেয়া হয়নি। শিক্ষক সংকট নিরসনে অন্যায়ভাবে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা তুলে খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে পাঠদান চালানো হচ্ছে। এসব শিক্ষক আবার অনভিজ্ঞ ও অদক্ষ। তবে ডিপ্লোমা কোর্সের কারিকুলাম বিভিন্ন সময়ে আধুনিকায়ন হয়েছে বলে জানান তিনি।

এ প্রসঙ্গে কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের সচিব মো. আমিনুল ইসলাম খান বলেন, নানারকম সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জ নিয়েই আমরা শুরু করেছি। অনেক ক্ষেত্রে হয়তো সাময়িক ব্যবস্থা অবলম্বন করে চলছি। ল্যাবরেটরি ও ক্লাসরুমের সংকট আছে। যা আছে তার সদ্ব্যবহার হচ্ছে না। এসবের কোনো কোনো সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে শিক্ষক সংকটের কারণে। বর্তমানে ৭ হাজার শিক্ষক কর্মরত আছেন। তবে আগামী রোববার আরও ১২৬০৭ শিক্ষকের পদ সৃষ্টি হচ্ছে। শূন্য ও নবসৃষ্ট পদে শিক্ষক নিয়োগ করা হবে। ৬ মাস পর হয়তো আমরা ভিন্ন বাস্তবতায় কথা বলতে পারব। তিনি বলেন, কারিকুলাম রিভিউ এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংযোগে হাত দিয়েছি। শিক্ষার্থীদের যথাযথ ইন্টার্নশিপের বিষয়েও পরিকল্পনা আছে। ভর্তির শর্তের বিষয়ে তিনি বলেন, ওনাদের সঙ্গে আলাপের পর নীতিমালা হয়েছে। প্রতি বছর ৭ হাজার আসন খালি থাকে বিধায় ভর্তিতে বয়সের শর্ত তুলে দেয়া হয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও কারিগরি বয়সের ক্ষেত্রে এই নীতি অনুসরণ করা হয়। এরপরও এ বছর বয়স্ক শিক্ষার্থী কেমন সংখ্যক ভর্তি হয় সেটার ভিত্তিতে পরে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে। আমরা সবার সহযোগিতায় এগিয়ে যেতে চাই।

মন্তব্য ( ০)





  • company_logo