• মুক্তমত

করোনা সংক্রমণ: শুধু অক্সিজেনেই বাঁচানো যাবে শত শত জীবন

  • মুক্তমত
  • ০৭ এপ্রিল, ২০২০ ২৩:৪৪:১৮

সিএনআই ডেস্ক: বিকেল ৩টার দিকে হাসপাতালের অফিস রুমে বসে। টেলিফোন বেজে উঠল। টেলিফোনে কান্নায় ভেঙে পড়ল আমার ২৫ বছরের সহকর্মীর স্ত্রী মার্টিনের অবস্থা খুব খারাপ। মার্টিন আমাদের ইনটেনসিভ কেয়ারের পরিচালক ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে। এখন সে মৃত্যুশয্যার। তিন দিন আগেও তাঁর সঙ্গে চা খেয়েছি এই রুমে বসে। এটাই বাস্তবতা এখন এলমহার্স্ট হাসপাতালের। বিশ্বের রাজধানী নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস বাঙালিদের প্রাণকেন্দ্র। এখানেরই একটি ছোট্ট হাসপাতাল এলমহার্স্ট। শত শত রোগীতে ভরে গেল এক সপ্তাহের মধ্যে। সাদা, কালো, বাঙালি, হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান—কাউকে ক্ষমা করেনি এ করোনাভাইরাস। আবারও প্রমাণিত হলো, মানুষ সবাই সমান। করোনা ভাইরাসকে নিয়ে সারা বিশ্ব আতঙ্কিত, সংগত কারণেই। এখন পর্যন্ত আমরা সঠিকভাবে জানি না এ ভাইরাসের উৎপত্তি কোথায়, শেষ কোথায়। ধারণা করা হচ্ছে, বাদুড় থেকে প্যাঙ্গোলিন নামে এক ধরনের প্রাণীর শরীরে এ ভাইরাস সংক্রামিত হয়। সেখান থেকে আসে মানুষে। ডিএনএ সিকোয়েন্সে পাওয়া গেছে এ পদচিহ্ন। ডিএনএ সিকোয়েন্সের মাধ্যমে আরও জানা গেছে, এ ভাইরাস মানুষের তৈরি না। ছোট ছোট পরিবর্তনের মাধ্যমে এ ভাইরাস তৈরি হয়েছে সাধারণ করোনাভাইরাস থেকে। এটা জীবাণু অস্ত্র না, সেটা প্রমাণিত হয়েছে। এ ভাইরাসের সব থেকে মারাত্মক দিক হলো, বড় বেশি সংক্রামক। দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে একজন থেকে আরেক জনে। সুখবর হলো, এ ভাইরাসে মৃত্যুর সম্ভাবনা অনেক কম। একজন সংক্রামক রোগবিশেষজ্ঞ হিসেবে খুব কাছ থেকে দেখলাম এ ভাইরাসের ক্ষমতা। অচল হয়ে গেল সাজানো সভ্যতা, বন্ধ হলো দোকানপাট, ব্যবসা-বাণিজ্য, উপাসনালয়। আমরা চিকিৎসক। মা-বাবা মৃত্যুশয্যায়, বাসায় ছোট বাচ্চারা একা। এটা প্রতিদিনের ঘটনা। এ রোগের কী চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে? বেশির ভাগ রোগীর কোনো চিকিৎসার দরকার হয় না, কোনো চিকিৎসা ছাড়াই ভালো হয়ে যাচ্ছে। দুর্ভাগ্য যাদের, তারাই আক্রান্ত হচ্ছে শ্বাসকষ্টে। বলা হচ্ছে শুধু শ্বাসকষ্ট হলেই হাসপাতালে আসতে। হাসপাতালে ভর্তি হলে প্রথমে দেওয়া হচ্ছে অক্সিজেন, তারপর হাইড্রোক্সিকলোরোকুইন ও জিথ্রোমাক্স। ধারণা করা হচ্ছে, এ দুটি ওষুধ ফুসফুসকে রক্ষা করে করোনা ভাইরাস থেকে। এরপরও যাদের অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না, তাদের দেওয়া হয়েছে পরীক্ষামূলক ওষুধ-Tocizimu। ab, siramu। ab এবং Ramdisivir, সেই সঙ্গে থাকছে আর্টিফিশিয়াল ভেন্টিলেশন (যন্ত্র দিয়ে শ্বাস দেওয়া)। এত কিছুর পরও মারা যাচ্ছে শত শত রোগী, আর কিছুই করার থাকছে না। এ ভাইরাস এ মারা যাওয়ার কারণ হচ্ছে শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া। এটি হয় যখন ভাইরাস ফুসফুসে ঢোকে, তখন শরীর থেকে এক ধরনের পদার্থ বের হয় যেটাকে আমরা cytokine বলি। এই cytokine তৈরি হয় ভাইরাস থেকে ফুসফুসকে রক্ষা করার জন্য। যখন এই cytokine অতিরিক্ত তৈরি হয়, তখন এই cytokine ধ্বংস করে ফুসফুসকে, এই রোগগুলোকে আর বাঁচানো সম্ভব হয় না। এমনকি আর্টিফিশিয়াল রেস্পিরেটর দিয়েও বাঁচানো সম্ভব হয় না এই পর্যায়ে। তাহলে কি করে আমরা এ ভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে পারি? নানা মুনির নানা মত, তবে কিছু কিছু ব্যাপারে সবাই একমত। যেমন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, কোয়ারেন্টিনে থাকা অথবা সম্পূর্ণভাবে লকডাউন করে দেওয়া। এগুলোর কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়েছে চীন ও ফ্রান্সে। আর যারা ব্যবস্থা গ্রহণে বিলম্ব করেছে (যেমন ইতালি ও আমেরিকা) তারাই ভুগছে অত্যধিক। লকডাউনের অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়া হতে পারে ভয়াবহ, সেই বিবেচনা থেকেই কোনো কোনো দেশ এই ব্যবস্থা গ্রহণে বিলম্ব করেছে। আশার কথা, এ ভাইরাস থেকে মুক্তির দিন খুব বেশি দূরে নয়। আশা করা হচ্ছে বেশির ভাগ (৯৮ শতাংশ) আক্রান্ত মানুষ ভালো হয়ে যাবে। শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হবে ৪ থেকে ৬ সপ্তাহে। এই মানুষগুলো আর নতুন করে সংক্রমিত হবে না। এ ছাড়া এই অ্যান্টিবডি যুক্ত রক্ত নিয়ে অসুস্থ মানুষকে দিলে তারা ভালো হয়ে যাবে। ভাইরাস মারার ওষুধও বেরিয়ে যাবে তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে। তা ছাড়া কার্যকর ভ্যাকসিন শুধু সময়ের ব্যাপার। আশা করা হচ্ছে ১২ থেকে ১৮ মাসের মধ্যে ভ্যাকসিনের ব্যবহার শুরু হয়ে যাবে। এটা হলো আমেরিকার কথা। আমেরিকার মতো সম্পদশালী দেশের এই অবস্থা। প্রিয় বাংলাদেশের কী হবে? এ চিন্তা অন্য সব প্রবাসী বাঙালির মতো আমারও। ঢাকা মেডিকেল কলেজের একজন প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে এবং উপজেলা মেডিকেল অফিসারের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, কী দুরূহ কাজ হবে বাংলাদেশের চিকিৎসক ও নীতিনির্ধারকদের। এ ক্ষেত্রে বলতে চাই, বাংলাদেশের কিছু লোকের ধারণা BCG ভ্যাকসিনেশন প্রতিরোধ করবে করোনা ভাইরাস থেকে। এটা ভ্রান্ত ধারণা। কারণ BCG ভ্যাকসিনেশনের কার্যকারিতা ১০ বৎসরের বেশি থাকে না। প্রমাণ নিউইয়র্কে বাঙালিরা (যাঁদের BCG দেওয়া আছে) এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন এবং মারাও গেছেন। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে সামাজিক দূরত্ব অথবা পূর্ণ লকডাউন সম্ভব বলে আমার মনে হয় না। র‍্যাপিড ডায়াগনোসিস ও নিশ্চিত আক্রান্ত রোগীদের আলাদা রাখাই সবচেয়ে কার্যকর হবে। সেই সঙ্গে ছোট ছোট চিকিৎসাকেন্দ্র খোলা আর অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা। শুধু অক্সিজেনেই বাঁচানো যাবে শত শত জীবন। আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে এটা বলছি। বাংলাদেশের চিকিৎসক ও নীতিনির্ধারকদের যদি সুস্থ হয়ে যাওয়া রোগীদের ব্লাড থেকে করোনা ভাইরাসের অ্যান্টিবডি (ইমিউনোগ্লোব্যুলিন) সংগ্রহ করার ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে মৃত্যুশয্যায় থাকা রোগীদের বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব হবে। বাংলাদেশের পক্ষে আছে গরম আবহাওয়া। গরমে এ ভাইরাস টেকে না। আরও ধারণা করা হচ্ছে, যখন বেশির ভাগ মানুষ ইমিউন হয়ে যাবে (৮০ শতাংশ কোনো উপসর্গ ছাড়াই ইমিউন হয়ে যাবে) তখন খুব কম লোকই এই ভাইরাসে আক্রান্ত হবে। যেটা কে আমরা herd ইমিউনিটি বলি। এই herd ইমিউনিটি খুব সম্ভবত রক্ষা করবে বাংলাদেশকে, সারা পৃথিবীকে। সময় আমাদের পক্ষে, ভাইরাসের পক্ষে নয়। এক বৎসরের মধ্যে আমরা সক্ষম হব করোনাভাইরাসকে দমন করতে। প্রশ্ন হলো, তত দিনে আর কত মাসুল দিতে হবে আমাদের জীবনের বিনিময়ে, মানবিক অনুভূতির মৃত্যুর বিনিময়ে? কত জীবন হারাব আমরা? আমর আশরাফ: নিউইয়র্কের মাউন্ট সিনাই স্কুল অব মেডিসিনের অধ্যাপক ও এলমহার্স্ট হাসপাতালের সংক্রামক রোগবিশেষজ্ঞ।

মন্তব্য ( ০)





  • company_logo