• বিশেষ প্রতিবেদন

জামালপুরে ‘অপূর্ব স্বাদের’ বুড়িমার মিষ্টি

  • বিশেষ প্রতিবেদন
  • ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪ ২২:৫৩:১৭

ছবিঃ সিএনআই

জামালপুর প্রতিনিধি: ‘বুড়ির দোকান গিয়ে তোরে মিষ্টি দিবো খাইতে’। সেই সারা জাগানো গানের বুড়ির ঐতিহ্যবাহী মিষ্টির দোকানটি জামালপুর জেলায় অবস্থিত। ঐতিহ্যের জেলা জামালপুরে রয়েছে নানা রকম ঐতিহ্য। নানা রকমের ঐতিহ্যের মধ্যে একটি হলো খাবার। নানা রকমের খাবারের মধ্যে ‘অপূর্ব স্বাদের’ বুড়িমার দোকানের মিষ্টি অন্যতম। মিষ্টির দোকানটি এই জেলার ঐতিহ্যবহন করে যাচ্ছে। ঐতিহ্যবাহী বুড়িমা মিষ্টান্ন ভান্ডারের নাম এতোই জনপ্রিয় যে, দেশ ও দেশের বাইরে থেকে কোনো দর্শনার্থী জামালপুর আসলে এই মিষ্টির স্বাদ একবার হলেও গ্রহণ করেন। মিষ্টির গুনগত মানের দিকে থেকেও এটি বহুল আলোচিত। 

জামালপুর শহরের প্রাণ কেন্দ্রে মেডিকেল রোডে গড়ে উঠা বুড়িমার মিষ্টির দোকানের মিষ্টির সুনাম জেলা ছাড়িয়ে দেশ এবং দেশের বাইরেও রয়েছে। এই দোকানকে ঘিরে মেডিকেল রোডের চার রাস্তার একটি মোড় ‘বুড়িমার’ মোড় হিসেবেই পরিচিতি পেয়েছে। জামালপুর প্রবেশ করে যে কেউ বুড়িমার মোড়ের কথা বললেই চলে আসা যায় এই মিষ্টির দোকানটিতে। 

এই দোকানে রাজভোগ, চমচম, সাদা চমচম, স্পন্স, ক্ষিরমোহন, ছানার পায়েস, মোন্ডা, কাঁচা গোল্লা, কালো জাম, মালাই চপ, হাসি-খুশি, ছানার পোলাও, প্যারা, সন্দেসসহ নানা রকমের মিষ্টি ছাড়াও এ দোকানে বিভিন্ন ধরনের দইসহ ঘি পাওয়া যায়। দই-চিড়া হচ্ছে এ দোকানের সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার।   

বুড়ি মার বংশ পরমপরায় দোকানটির মালিক সুমন কুমার সাহা জানান, ‘বুড়িমার পুরো নাম অমিয় বালা সাহা। তিনি বিয়ে করেন মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়া উপজেলার বালিয়াটি গ্রামের শম্ভু নাথ সাহাকে। স্বাধীনতা যুদ্ধের অনেক আগে জীবিকার সন্ধানে স্বামীর সাথে জামালপুরে পাড়ি জমান বুড়িমা। স্বল্প পুঁজি নিয়ে তাঁর স্বামী কাপড়ের ব্যবসা শুরু করেন। সেই ব্যবসা থেকে যে উপার্জন আসতো তাতে সংসার চলতো না। বুড়িমার এক বান্ধবী তাকে দই ও মিস্টি বানানো শিখিয়ে ছিলেন। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বুড়িমা বাড়তি আয়ের জন্য শহরের মেডিকেল রোডে ছোট্ট করে দই-চিড়ার দোকান দেন।

তাঁর এ কাজে কিশোর বয়সেই সহযোগিতা করেতেন বড় ছেলে নারায়ণ চন্দ্র সাহা। বুড়িমার স্বামী শম্ভু নাথ সাহা মারা যাওয়ার পর ছেলেকে নিয়ে রাতদিন হাড় ভাংগা পরিশ্রম করে দই-চিড়া ব্যবসাটি চালিয়ে যায়। সেই সময় তিনি পদ্ম পাতায় দই-চিড়া বিক্রি করতেন। তাঁর তৈরি সুস্বাদু দই-চিড়ার সুনাম জেলা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। ব্যবসা ভাল হওয়ায় দই-চিড়ার সাথে মিষ্টি বানানো শুরু করেন তিনি। এরপর তাঁকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। পরে তিনি গড়ে তোলেন মা মিষ্টান্ন ভান্ডার যা বুড়িমার মিষ্টির দোকান নামে বহুল পরিচিত। বুড়িমার বড় ছেলে লেখাপড়া না করলেও ছোট ছেলে লেখাপড়া করে জামালপুর জজকোর্টের আইনজীবী হয়ে ছিলেন। তাদের পারিবারিক প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে নারায়ণ চন্দ্র সাহার ছেলে বুড়িমার নাতি সুমন কুমার সাহা পরিচালনা করেছেন।

বুড়ি মা থাকাকালীন সময়ের মিষ্টি তৈরির কারিগররা এখনো বেঁচে আছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন রাম চন্দ্র বসাক। তিনি বলেন, ‘আমি বুড়ি মা থাকাকালীন সময় থেকে এখান পর্যন্ত কাজ কওে যাচ্ছি। আমি  মিষ্টি বানানো তাঁর কাছ থেকে শিখেছি। সেই সময় বুড়িমার সাথে যেভাবে নানা রকমের মিষ্টি তৈরি করেছি। এখনো সেভাবেই মিষ্টি তৈরি করে যাচ্ছি। আমাদের মিষ্টির গুনগতমান ও স্বাদ আগে যেমন ছিলো এখনো তেমনই রয়েছে। বুড়ি মার সেই ধারাবাহিকতায় মিষ্টি তৈরি করে যাচ্ছি। তাই আমাদের মিষ্টির সুনাম জেলা ছাড়িয়ে দেশ ও দেশের বাইরেও ছড়িয়ে গেছে’।

ভোজন প্রিয় কয়েকজন ক্রেতা বলেন, ‘বুড়িমার দোকানের মিষ্টি এ জেলার ঐতিহ্য। বুড়িমার দোকানের মিষ্টির স্বাদ আগের মতোই রয়েছে। বুড়িমা থাকাকালীন সময়ের পদ্ম পাতার দই-চিড়া ও মিষ্টির স্বাদ এখনো পাওয়া যায়। সামাজিক অনুষ্ঠানে ও আত্মীয় বাড়িতে বুড়িমার দোকানের মিষ্টি না হলে যেন পরিপূর্নতা আসে না। 

তাঁরা আরও জানান, জামালপুর-শেরপুরসহ আশপাশের কয়েকটি জেলার মানুষের একটি রেওয়াজ রয়েছে। এ অঞ্চলের মূমূর্ষ রোগী বা মৃত্যু পথযাত্রী মানুষ তিনি কিছু খাবেন কি না জিজ্ঞাসা করা হলে অধিকাংশ মানুষই বুড়িমার দোকানের দই-চিড়া বা মিষ্টি খাওয়ার কথা বলেন। এই দোকানের মিষ্টি ও দই-চিড়ার সুনাম রয়েছে। 

নেত্রকোনা থেকে একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার জন্য জামালপুরে এসেছেন আবু সাঈদ। তিনি বলেন, বুড়িমার দোকানের সুনাম অনেক শুনেছি। ইচ্ছা ছিলো বুড়িমার দোকানের মিষ্টি খাবো। সেই সুবাদেই বুড়িমার দোকান খুজে মিষ্টি খেতে এসেছি। মিষ্টি আমার পছন্দের খাবার। 

এ বিষয়ে মা মিষ্টান্ন ভান্ডারের (বুড়িমার দোকান) স্বত্ত্বাধিকারী সুমন কুমার সাহা বলেন, ‘আমার ঠাকুর মা যেভাবে বিভিন্ন বাজার থেকে দুধ সংগ্রহ করে মিষ্টি তৈরি করতেন, আমি তাঁরই ধারাবাহিকতায় মিষ্টি তৈরি করে যাচ্ছি। তাঁর তৈরি মিষ্টির গুনগতমান ও স্বাদ ধরে রেখেই দোকান পরিচালনা করছি। এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে’।

প্রসঙ্গত, সারা জাগানো চলচ্চিত্র ‘হৃদয়ের কথা’ সিনেমার একটি গানেও জামালপুরের বুড়ির দোকানের মিষ্টির কথা বলা হয়েছে। বুড়িমার দোকানের সমৃদ্ধ মিষ্টান্নের মাধ্যমে জামালপুরবাসীর মন জয় করে আছে এখনো। জেলার মিষ্টান্নর চাহিদা বেশিরভাগ অংশই এই দোকান থেকেই পূরন হয়ে থাকে।

মন্তব্য ( ০)





  • company_logo