
নিউজ ডেস্কঃ ফের আতঙ্ক ছড়াচ্ছে নিপাহ ভাইরাস। এবার দক্ষিণ ভারতের কেরালা রাজ্যে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ২ জনের মৃত্যুর পর রাজ্যজুড়ে জারি করা হয়েছে বিশেষ সতর্কতা। রাজ্যটিতে এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন এক হাজার ৮০ জন। তাদের মধ্যে ৩২৭ জনই স্বাস্থ্যকর্মী।
নিপাহ ভাইরাসের কোনো ওষুধ ও টিকা নেই। শুধু উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা দেওয়া হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, নিপাহ ভাইরাসে মৃত্যুর হার ৪০ থেকে ৭৫ শতাংশ। বাংলাদেশে এই হার ৭১ শতাংশ। আর ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ (আইসিএমআর) বলছে, কোভিডের ২-৩ শতাংশের তুলনায় নিপাহ ভাইরাসে মৃত্যুর হার ৪০-৭০ শতাংশের মধ্যে রয়েছে।
কেরালা কোঝিকড় হাসপাতালে সম্প্রতি ২ জনের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়। ঠিক কী কারণে তাদের মৃত্যু হয়েছে তা স্পষ্ট নয়। তবে যে উপসর্গের জেরে তাদের মৃত্যু হয়েছে, সেটা নিপা ভাইরাস সংক্রমণের লক্ষণ বলে চিকিৎসকরা দাবি করেছেন। একই উপসর্গ নিয়ে এই হাসপাতালে আরও ৩ শিশুসহ ৪ জন ভর্তি রয়েছেন। ফলে উদ্বেগ বাড়ছে।
হাসপাতাল সূত্রের বরাত দিয়ে ভারতের সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, সম্প্রতি কোঝিকড়ের এক বেসরকারি হাসপাতালে যে ২ জনের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে তাদরই এক আত্মীয়, ২২ বছরের যুবকও একই উপসর্গ নিয়ে ওই হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। বর্তমানে তিনি আইসিইউতে রয়েছেন। এছাড়া যে ৩ শিশু ভর্তি রয়েছে তাদের মধ্যে ৪ বছর, ৯ বছর থেকে ১০ মাস বয়সের শিশুও রয়েছে। এদের সবারই জ্বর, সর্দি, শ্বাসকষ্টের মতো উপসর্গ রয়েছে।
বছর দুয়েক আগেও নিপা ভাইরাসের সংক্রমণ মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল এই রাজ্যে। তাই আগাম সতর্কতা নিতে তৎপর পিনারাই বিজয়নের সরকার। নিপা-সংক্রমণ নিয়ে ইতোমধ্যে রাজ্যের স্বাস্থ্য আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন কেরালা স্বাস্থ্যমন্ত্রী বীণা জর্জ।
আক্রান্তদের রক্তের নমুনা পুনের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ভাইরোলজিতে পাঠানো হয়েছে। ওই রিপোর্ট এলেই রাজ্যে নিপা সংক্রমণ আদৌ হয়েছে কিনা তা স্পষ্ট হবে। তবে নিপা সংক্রমণ ঠেকাতে আগাম সতর্কতা মেনে চলার পরামর্শ দিচ্ছেন রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
এদিকে, কেরালায় নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব এবং কোভিডের তুলনায় এর উচ্চ মৃত্যুর হারের পরিপ্রেক্ষিতে ভাইরাল রোগটির বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন তৈরির কাজ শুরু করার পরিকল্পনা করছে আইসিএমআর।
সংস্থাটির প্রধান রাজিব বাহুল বলেন, ‘২০১৮ সালে অস্ট্রেলিয়া থেকে মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডির কিছু ডোজ পাই। এখন কেবল ১০ জন রোগীর এই ডোজ রয়েছে। আমরা মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডির আরও ২০ ডোজ সরবরাহ করতে অস্ট্রেলিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়েছি।
ভারতের বাইরে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত ১৪ জন মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি চিকিৎসা গ্রহণের পর সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেছেন বলেও জানান রাজিব বাহুল।
তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৮ সালে মালয়েশিয়ায় প্রথম এ ভাইরাসটির সংক্রমণের কথা জানা যায়। আর আইসিডিডিআর,বির তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ সালে বাংলাদেশের মেহেরপুর জেলায় এই ভাইরাস শনাক্ত হয়। ২০০৩, ২০০৪ ও ২০০৫ সালে নওগাঁ, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর ও টাঙ্গাইল জেলায় এই রোগের প্রকোপ ঘটে।
দেশে এ পর্যন্ত ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৩২৬ জন, এদের মধ্যে মারা গেছেন ২৩১ জন। ২০০৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পরীক্ষার মাধ্যমে এই ভাইরাসকে ‘নিপাহ ভাইরাস’ বলে শনাক্ত করা হয়।
এদিকে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২৭ মার্চ পর্যন্ত দেশে ১৪ জনের নিপাহ ভাইরাস শনাক্ত হয়। এর মধ্যে মারা যান ১৪ জন। এবার ভারতের দক্ষিণ কেরালা রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছে ভাইরাসটি।
বিশেষজ্ঞরা জানান, সাধারণত শীতকালে (জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে) নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এ ভাইরাস সংক্রমণে শতকরা প্রায় ৮০ শতাংশের মৃত্যু হতে পারে। ভাইরাস সংক্রমণের প্রায় এক সপ্তাহ পর রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে, জ্বর, প্রলাপ বকা এবং অজ্ঞান হয়ে পড়া।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ও দেশের শীর্ষ ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম জানান, নিপাহ ভাইরাসের প্রধান বাহক বাদুড়। তাই বাদুড় খেয়েছে এমন কোনো ফল খাওয়া যাবে না। যারা এ ভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসা দেবেন তাদেরও সচেতন থাকতে হবে। মাস্ক ও গ্লাভস পরিধান করতে হবে। কারণ এই রোগ একজন থেকে আরেকজনের মধ্যে ছড়ায়।
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ জানান, এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ হলেও পরবর্তীতে গুরুতর স্নায়বিক জটিলতায় পড়ার আশঙ্কা থাকে। গর্ভবতী নারীদের গর্ভাবস্থার শেষদিকে এই জটিলতা আরও খারাপ হয়। ফলে সবাইকে এ ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে।
মন্তব্য ( ০)