• সমগ্র বাংলা

ভারতের আজমুল বেগম,বাংলাদেশের অন্ধ মস্তুকে স্বপ্ন দেখিয়েছে নতুন করে বাঁচার

  • সমগ্র বাংলা
  • ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ১৫:২৫:০৯

ছবিঃ সিএনআই

পঞ্চগড় প্রতিনিধি: ভাল লাগা থেকে ভালবাসা। ভালোবাসা মানে না কোনো যুক্তি, কোন বিধি নিষেধ। করে না হিসাব-নিকেশ,ভাবে না এপার বাংলা কিংবা ওপার বাংলা সব কিছুর মাঝেই যেন ভালবাসা আর এক সাথে জীবন চলা। তেমনই এক অজানা কন্টকাকীর্ণ ভবিষ্যৎ হাসিমুখে বেছে নিয়েছেন ভারতের হাওড়া জেলার বড়গাছিয়া থানার পাতিয়াল গ্রামে পাতিয়াল রেলস্টেশন এলাকায় বেড়ে উঠা মোছা: আসমুল বেগম(৪২)। পরিবারের মা,বাবা,ভাই,বোন আত্মীয়-স্বজন সবার মায়া ত্যাগ করে সবার অমতে পঞ্চগড় সদর উপজেলার চাকলা হাট ইউনিয়নের মেহের পাড়া গ্রামের গোলাম মোস্তফা ওরফে অন্ধ মস্তুর(৪৭) হাত ধরে চলে আসেন বাংলাদেশে।

জানা যায়,ছোট বেলায় সব কিছু ঠিক থাকলেও হঠাৎ টাইফয়েডে জ্বরে দু চোখ অন্ধ হয়ে যায় মস্তুর।বাবা মা দেখাশোনা করলেও ১২ বছর বয়সে হঠাৎ বাবা মারা যান সংসারে হাল ধরেন তিনি। শুরু হয় অভাবের সংসার। কোন কিছু কাজকর্ম করতে না পারায় হাটবাজারে গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহ শুরু করেন মস্তু। সে সময় বাংলাদেশ,ভারত কাটা তারের বেড়া না থাকায় আজমী শরীফ যাওয়া আসা করতেন তিনি।

যাওয়া আসার এক পর্যায়ে পাতিয়াল এলাকায় রেল স্টেশনে জীপিকার তাগিদে গান শুরু করে।এদিকে আজমল রেলস্টেশনের পাশে বাড়ি থাকায় তার গান শুনতে যায় এবং গান শুনে তার প্রতি মুগ্ধ হয়ে ভালোলাগা,তার সাথে কথা, ভালোবাসা,এরপর বিয়েতে রুপ নেয়। কিন্তু চোখ হীন জীবন নিয়ে কারো জীবনসঙ্গী হওয়াই ছিল অনেকটাই দুষ্প্রাপ্য মস্তুর। তবে আজমুল বেগমের ভালোবাসা তাকে স্বপ্ন দেখিয়েছে নতুন করে বাঁচার।

এরপর স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেওয়ায় চলে আসেন বাংলাদেশ।ঐ সময় সীমান্তে কাটা তারের বেড়া না থাকায় প্রায় সময় যাতায়াত ছিল দুজনের বাংলাদেশ-ভারত।এর মধ্যে বেড়া কাটা হয়ে গেলে পরিবার পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় আজমুল।কষ্টের মাঝে সব কিছুকে বিসর্জন দিয়ে বাংলাদেশর নাগরিকত্ব নিয়ে স্বামীকে নিয়ে সংসার জীবন শুরু করেন আজমুল।এখন স্বামীসহ ১ ছেলে এবং ২ মেয়ে নিয়ে সংসার করছেন তিনি। ১ মেয়ের বিয়ে হলেও অরেক মেয়ে পড়েন একটি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে, ছেলে পড়ছে হাফিজিয়া মাদ্রাসার হেফজখানায়।এক দিকে অভাবের সংসার,অন্য দিকে স্বামীর শরীরে বাসা বেধেছে নানান ধরনের রোগ।

তার পরেও আজমুলের ঘাড়ে হাত চেপে কষ্ট হলেও কখনো বাজারে আবার কখনো গ্রামের মানুষের কাছে টাকা তুলে যা আয় হয় তা দিয়ে ছেলে মেয়ের লেখাপড়া খরচ,নিজের ঔষধের পাশাপাশি চলে সংসার।এতে তাদের চলতে কষ্ট হলেও জীবন যুদ্ধে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে যাচ্ছে মস্ত আর আজমল।কিন্তু ওপার বাংলা থেকে ছেড়ে আসা আজমুল শত কষ্টের মাঝেও তার ভালোবাসার মানুষটিকে প্রশাসন সহ সবার আর্থিক সহযোগিতায় সুস্থ দেখতে চান।সরেজমিনে গিয়ে কথা বলে জানা যায়,অন্ধ মস্তু ও আজমুল একটি সরকারি ঘর এবং সমাজসেবা থেকে প্রতি মাসে প্রতিবন্ধী ভাতা হিসাবে ৮৫০ টাকা করে পেলেও এখন কখনো তিন মাস কখনো পাঁচ মাস পরে ২৪৫০ টাকা পান।

এই টাকা দিয়ে চলছে না তাদের সংসার। নিজের অসুস্থতা, খাওয়া দাওয়া, ছেলে মেয়ের লেখাপড়া,ঔষধ এসবের টাকা জোগাড় করাই যেন তার কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।অসুস্থ শরীর নিয়ে সেই ভালোবাসার স্ত্রীর ঘাড়ে হাত চেপে হাটে বাজারে হাত পেতে হচ্ছে মানুষের কাছে। অন্ধ মস্তু সিএনআইকে বলেন, এর আগে যেভাবে চলাফেরা করতাম এখন আর সেভাবে চলাফেরা করতে পারছি না, শরীরের ব্যথা সহ নানান রোগে ভুগছি। প্রতিদিনেই সন্ধ্যা হলে ৯০ টাকার ঔষধ কিনতে হয়। একদিকে ঔষধ কেনা অন্যদিকে সংসার খরচ, ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার খরচ অনেক কষ্ট করে চলতে হচ্ছে। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে কোন সুযোগ সুবিধা তো দুরের কথা বছরে এক কেজি চালও দেওয়া হয় না।আমি অন্ধ মানুষ কি ভাবে চলবো।

আসমুল বেগম বলেন,আমি সবাইকে ছেড়ে অন্ধ একটা মানুষের সাথে সংসার করছি।এমন সময় সারা দিন তাকে নিয়ে গ্রামে গঞ্জে হাটবাজারে ঘুরে টাকা তুলে যা টাকা উঠতো তা দিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাতাম এখন আমার স্বামী সুস্থতার কারণে বেশি হাটা চলা করতে পারে না আমিও আর পারিনা। তাই সরকারি বেসরকারি ভাবে যদি সবাই আমাদেরকে সাহায্য সহযোগিতা করে তাহলে অসুস্থ স্বামীকে চিকিৎসা করা সম্ভব হবে।

এলাকাবাসী মো: বাহাদুর আলী সিএনআইকে বলেন,একটি মেয়ে তার পরিবারের সবাইকে ছেড়ে এক দেশ থেকে আরেক দেশে এসে অন্ধ একটি ছেলের সাথে সংসার করছেন মানুষের প্রতি মানুষের যে ভালোবাসা সেটি তিনি দেখিয়েছেন এবং বুঝিয়েছেন। মস্ত তার স্ত্রীর  ঘাড়ে হাত ধরে হাট বাজার গ্রামে গিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করে সংসার চালান। এখন তার অসুস্থতার কারণে সে বেশি চলাচল করতে পারে না সরকারি ভাবে আর্থিক সহযোগিতা করলে সে হয়তো সুস্থ হয়ে উঠতে পারে।

চাকলাহাট ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো: ফরহাদ হোসেন সিএনআইকে বলেন,মস্ত একটি সৎ এবং ভালো ছেলে।আমরা যতটুকু পারি তার চিকিৎসায় পাশে দাঁড়াবো। পাশাপাশি এলাকাবাসী এবং সরকারিভাবে যদি মস্তকে সাহায্য সহযোগিতা করা হয় তাহলে পৃথিবী দেখতে না পেলেও সুস্থভাবে স্ত্রী ছেলে সন্তান নিয়ে জীবন যাপন করতে পারবে।

চাকলা হাট ইউনিয়ন পরিষদের ৪ নং ওয়ার্ডের  ইউপি সদস্য মোঃ রাসেল আলী সিএনআইকে বলেন,মস্তু একজন অন্ধ মানুষ সে ভিক্ষাবৃত্তি করে খায় পাশাপাশি সে প্রতিবন্ধী ভাতা পায়, আমি ব্যক্তিগতভাবে যতটুকু পারি দেখা হলে সহযোগিতা করি, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে এখন তেমন কোন সুযোগ সুবিধা নেই। এরপরে কোন সুযোগ সুবিধা এলে তাকে সহযোগিতা করা হবে।

চাকলা হাট ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান মো: মোজাম্মেল হক সিএনআইকে বলেন, মস্তকে আমি জানি এবং চিনি সে একজন অন্ধ মানুষ আমি তার অসুস্থতার কথা শুনলাম আমরা ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে অথবা ব্যক্তিগতভাবে যতটুকু সহযোগিতা করা যায় আমরা করবো।পাশাপাশি তার যে কোনখানে সহযোগিতার প্রয়োজন হলে আমরা ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে তার জন্য সুপারিশ করবো।

মন্তব্য ( ০)





  • company_logo