• উদ্যোক্তা খবর

টেকনাফে আলট্রা-পুওর গ্রেজুয়েশন প্রোগ্রাম, বিধবা আনোয়ারা এখন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী

  • উদ্যোক্তা খবর
  • ১০ ডিসেম্বর, ২০২২ ১৮:০৩:২১

ছবিঃ সিএনআই

জাবেদ ইকবাল চৌধুরী, কক্সবাজার  : আনোয়ারা বেগম (৪৪)। বিধবা নারী। চার সন্তান নিয়ে সংসার চালাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছিলেন। স্বামীর অবর্তমানে সংসার পরিচালনা করা দূরহ হয়ে উঠে। ঠিক  এ সময় ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে সদস্য হয় আলট্রা-পুওর গ্রেজুয়েশন (ইউপিজি) প্রোগ্রামের। সে টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নের উপকূলীয় এলাকা শাহপরীর দ্বীপ মাঝের পাড়ার মৃত আমির আহমদের স্ত্রী। ২০২০ সালের ৫ অক্টোবর সে "কদমফুল ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী নারী দলের সদস্য অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৮ অক্টোবর ২২ হাজার টাকা মূল্যমানের একটি বকনা গরু সহায়তা পায় সে। এটি বর্তমানে একটি বাছুর প্রসব করেছে।  পাশাপাশি সে ব্র্যাক থেকে কয়েক দফায় ৭০ হাজার টাকা ঋণ

নিয়ে নিজ ভিটা জমিতে  শুরু করে মুদি দোকানের ব্যবসা। পাশাপাশি গত দু বছরে বিধবা আনোয়ার বেগম  নিজের দোকানের এক পাশে গড়ে তুলেছে মুরগী পালনের খামার।  সেখানে প্রায় ৩০০ টি মুরগী বাচ্চা লাগান পালন করা হচ্ছে বলে জানান আনোয়ারা। 

তিনি বলেন, " শাহপরীর দ্বীপের মাঝের পাড়ায় একদিকে সাগরের উত্তাল ঢেউ, বেড়িবাঁধ ভাংগনের আতংক, অন্যদিকে স্বামী বিহীন চার সন্তান নিয়ে অভাব অনটন দারুণ ভাবে গ্রাস করছিল। সেই সময় ব্র্যাকের কর্মীরা আশার আলো হয়ে দাড়িয়েছে।

তারা বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে গড়ে তুলেছে। এখন নিজেই দোকান, মুরগী পালন, গবাদিপশু পালন,শুটকি উৎপাদন থেকে সবকিছু করতে পারি৷ দু " সন্তানকে ৩০ হাজার টাকা খরচ করে ৩ টি জাল কিনে দিয়েছি। তারা প্রতিনিয়ত সাগরে জাল ফেলে মাছ ধরে। ছোট  দু সন্তান পড়াশোনা করছে। আর আনোয়ারা নিজে দোকানের বেচাবিক্রি ও ব্যবসা নিয়ে সুখে শান্তিতে সংসার চলছ" 

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বিধবা আনোয়ার বেগম একজন আত্মপ্রত্যয়ী শক্তিশালী নারী ব্যবসায়ী হিসেবে নিজকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। একাই ছাগল, গরু- বাছুর সামলানো, মুদি দোকানে সরাসরি বেচাকেনা, মুরগী খামার দেখাশোনা থেকে সবকিছুই একা করছেন। বঙ্গোপসাগরে জাল ফেলে মাছ ধরার কাজটি শুধু বড় ছেলেকে দিয়ে করিয়ে তাকেও কর্মজীবী হিসেবে গড়ে তুলতে পেরেছেন। যার কারণে বর্তমানে আনোয়ারা বেগম প্রায় আড়াই লাখ টাকার পুঁজির মালিক। 

এভাবে শাহপরীর দ্বীপের মাঝের পাড়ার বিধবা  আমেনা  খাতুন ও মনোয়ারা বেগম শুটকি মাছের ব্যবসা, হাজী পাড়ার স্বামী পরিত্যক্তা হালিমা খাতুন কাপড় সেলাই ও ব্যবসা করে এখন স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে। 

এখন তারা সম্মিলিত ভাবে পণ্য কেনা বেচা করে মার্কেট ডেভেলপমেন্ট করার কাজ টুকু সমৃদ্ধ করছেন বলে দাবী করেন নারী ব্যবসায়ী আমিনা খাতুন। তিনি বলেন," ব্যবস্যা আলাদা আলাদা হলেও সমিতির সদস্যদের একজন শুটকি মাছের মূল ঠিক করে সম্মিলিত ভাবে বিক্রি করে থাকি, এ ছাড়া কোন কিছু কিনতে হলেও তুলনামূলক যাচাই-বাছাই একজনে সম্মিলিত ভাবে পণ্য কেনা হয়। এতে যাতায়াত খরচ কমে আসে। পাশাপাশি সময় ও শ্রমও বাঁচে। "

অনুসন্ধানে জানা যায়, ব্র্যাক ২০০২ সালে বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচনের একটি মডেল উদ্ভাবন করে, যা সারা বিশ্বে গ্রাজুযেশন অ্যাপ্রোচ নামে পরিচিত।

বাংলাদেশে পরিচালিত ব্র্যাকের গ্রাজুয়েশন প্রোগ্রামটির মাধ্যমে ব্র্যাক এ পর্যন্ত ৪৮টি জেলার প্রায় ২২ লাখ পরিবারকে উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃক্ত হতে সহায়তা করেছে। ২০০৭ সালে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস-এর গবেষকবৃন্দ এই কর্মসূচির ওপর রেনডোমাইজড কন্ট্রোল ট্রায়াল পদ্ধতি প্রযোগের ভিত্তিতে একটি বিস্তৃত গবেষণাকর্মে যুক্ত হন। তাঁদের গবেষণার দেখা গেছে দুবছর মেয়াদি এই কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারী পরিবারগুলোর ৯৩ শতাংশ সাত বছর পরও নিজেদের ধারাবাহিক উন্নতি বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে।

“মাল্টি-সেক্টরাল ইমার্জেন্সি এসিস্ট্যান্ট ফর রোহিংগা প্রোজেক্ট ইন কক্সবাজার, বাংলাদেশ"-এর প্রকল্প ব্যবস্থাপক মোহাম্মাদ কায়সার পারভেজ জানান, " আন্তর্জাতিক শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এর অর্থায়নে ২০১৮ সাল হতে ২০২২ সাল পর্যন্ত উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার মোট ১০ টি ইউনিয়নে রোহিঙ্গা আগমনের কারণে অর্থনৈতিকভাবে চাপের থাকা ৪ হাজার ২৮ অতিদরিদ্র পরিবারকে স্বাবলম্বী করতে বসতবাড়িতে সবজি চাষ, কৃষি, হাঁসমুরগি ও গবাদি পশু (গরু, ছাগল পালনে প্রশিক্ষণ প্রদান করে এন্টারপ্রাইজ অনুযায়ী সম্পদ হস্তান্তর করা হয়, এবং যা ২৪ মাস যাবত হোম ও গ্রুপ ভিজিটের  মাধ্যমে যথাযথ হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দিয়ে তাদেরকে টেকসই জীবিকায়ন এবং আর্থ সামাজিক উন্নয়ন অর্জনের জন্য প্রস্তুত হতে সহায়তা করা হয় এই সদস্যের ৯৫% কর্মসূচি থেকে গ্র্যাজুয়েট হওয়ার মাধ্যমে টেকসই উন্নয়নের এই প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন।

তিনি আরও জানান, উথিয়া ও টেকনাফে ২০০০ গ্র্যাজুয়েট সদস্য নিয়ে মার্কেট লিংকেজ ইনিসিয়েটিভ অব্যাহত রয়েছে যার মূল উদ্দেশ্য হলো সদস্যদেরকে অর্থনৈতিকভাবে আরও বেগবান করা এবং টেকসই উন্নয়নে বাজার ব্যবস্থাপনার সাথে সম্পৃক্ত করা। মার্কেট লিংকেজ কার্যক্রমের আওতায় সদস্যরা উদ্যোক্তা উন্নয়নের প্রশিক্ষণ, ব্যাকওয়ার্ড ও ফরোয়ার্ড মার্কেট এক্টরদের সাথে গ্রুপ মিটিং সরকারি দপ্তর বিশেষ করে

উপজেলা যুব উন্নয়ন অফিস, প্রাণিসম্পদ অফিস, সমাজসেবা অফিস, মহিলা বিষয়ক অফিস, কৃষি সম্প্রসারণ অফিস, মৎস্য অফিস"  এর কর্মকর্তাদের সাথে গ্রুপ মিটিং এ যুক্ত হয়েছেন, তারা এখন দলীয় ভাবে প্রয়োজনীয় ইনপুট যেমন- গবাদিপ্রানির দানাদার খাবার, ড্যাকসিন, ভিটামিন, বীজ, সার ইত্যাদি সাশ্রয়ী মূল্যে ক্রয় করেন অনুরূপভাবে তারা দলীয় ভাবে তাদের উৎপাদিত পণ্য যেমন- সবজি, হাস-মুরগি, ডিম, দুধ, পান, গবাদিপ্রানি ইত্যাদি দলের সভানেত্রীর নেতৃত্বে বাজার যাচাই করে পাইকারদের কাছে বিক্রি করেন। এবং বাজারের চাহিদা বিবেচনা করে নতুন ভাবে ২৫ জন ভার্মিক কম্পোস্ট সার উৎপাদন উদ্যোক্তা তৈরি করা হয়েছে, যাদের কার্যক্রম চলমান রযেছে। এছাড়াও মোট ৮৯ টি দলের ৮৯ জন দলনেত্রীদের নেতৃত্ব বিকাশে মিটিং অনুষ্ঠিত হয়েছে।

উল্লেখ্য যে, কক্সবাজার জেলায় ২০০৯ সালে আলট্রা-পুওর গ্রাজুয়েশন প্রোগ্রামের কার্যক্রম শুরু হয়। ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই জেলার ২২৩১৬ টি অতিদরিদ্র পরিবার ব্র্যাকের আলট্রা-পুওর গ্র্যাজুযেশন প্রোগ্রামের আওতায় এসেছে। ২০২২ সালে কক্সবাজার জেলায় এই কর্মসূচিতে ২টি উপজেলার ২০০০ টি অতিদরিদ্র পরিবার যুক্ত রয়েছে, যার মধ্যে  কক্সবাজার জেলার সীমান্ত উপজেলা টেকবাফের দুটি ইউনিয়ন সাবরাং ও টেকনাফ সদরের ৭৪৮টি পরিবারেএ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে ব্র্যাক। ইউএনএইচসিআর-এর সহায়তার এর আগে ২০১৮-২০১৯ সালে উপজেলার হ্নীলা ও হোয়াইক্যং ইউনিয়নে এ ধরনের প্রকল্প শেষ করে উন্নয়ন সংস্হা ব্র্যাক।

মন্তব্য ( ০)





  • company_logo