• বিশেষ প্রতিবেদন
  • লিড নিউজ

তেঁতুলিয়ায় কাঁচা চা পাতার দাম নেই, হতাশায় চা চাষিরা

  • বিশেষ প্রতিবেদন
  • লিড নিউজ
  • ১১ মে, ২০২২ ১৩:০৫:৫৮

ছবিঃ সিএনআই

এস কে দোয়েল,তেঁতুলিয়া (পঞ্চগড়): চা উৎপাদনে পঞ্চগড়ের অতীতের সব রেকর্ড ভাঙলেও কাঁচা চা পাতার দরপতনে কৃষকদের নাভি: শ্বাস উঠেছে। চলতি মৌসুমের চা পাতার ন্যায্য মূল্য পাওয়ায় চোখে-মুখে অন্ধকার দেখছেন এমনই জানাচ্ছেন কৃষকরা।  তারা জানাচ্ছেন, মৌসুমে বাগান ভরা পাতা, কিন্তু দাম নেই। মজুরী ও সার-কীটনাশকসহ খরচের বেশির ভাগ চলে যাচ্ছে। এতে করে লাভের জায়গায় লোকসান গুণতে হচ্ছে।  এভাবে চলতে থাকলে মাঠে মরতে হবে এমনটাই হতাশার কথা জানাচ্ছেন কৃষকরা।

জানা যায়, মার্চ মাস থেকে শুরু হয় প্রথম চা পাতা কাটা ও সংগ্রহের কার্যক্রম। কৃষকরা বাগান থেকে চা-পাতা কাটার পর স্থানীয় কারখানায় বিক্রি করেন। গত এক দশকে চা শিল্পে দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলা পঞ্চগড়ের কৃষকদের জীবন মান বদলে গেছে। মহামারী করোনাকালেও দেশে চা উৎপাদনে রেকর্ড করেছে এ জেলা। তবে এ মৌসুমের কাচা চা পাতার ন্যায্য দামের শঙ্কায় হতাশায় ভুগছেন চাষিরা। কাঁচা চা পাতার মূল্য ২২/২৩ টাকা থেকে ১১/১২ টাকায় আসায় মূল্য বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলনে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা।

এ অঞ্চলের সমতল ভূমির চা বাগান ও ক্ষুদ্র চা চাষিদের হাতে রেকর্ড পরিমাণ চা উৎপাদনে পার্বত্য জেলা চট্টগ্রামকে ছাড়িয়ে গেছে। অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ২০২১ সালে উত্তরাঞ্চলের সমতল ভূমিতে ১৪ দশমিক ৫৪ মিলিয়ন কেজি চা রেকর্ড পরিমাণ উৎপাদন হয়েছে। ২০২০ সালে ১০ দশমিক ৩০ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন হয়েছে। এ জেলার পাঁচটি উপজেলার মধ্যে সর্বাধিক চা বাগান তেঁতুলিয়া উপজেলায়।

চা বাগান বৃদ্ধিতে এ জেলায় ১৪ টিরও বেশি গড়ে উঠেছে চা কারখানা সবচেয়ে বেশি চা কারখানা তেঁতুলিয়ায়। চা শিল্প ঘিরে নতুন নতুন কারখানা গড়ে উঠলেও চা পাতার দাম না পাওয়ায় হতাশ প্রান্তিক চাষিরা। অর্থনৈতিকভাবে লোকসান গুণতে হচ্ছে চাষিদের। এমনটা চলতে থাকলে মুখ থুবড়ে পড়তে পারে সমতলের চা-শিল্প। তবে অর্থনীতির চাকা সচল রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন চাষিরা।

চা আবাদে নগদ অর্থ আয়ের আশায় সাধারণ চাষিরা কৃষি জমি, বাঁশ ঝাঁর, বনজ ও ফলদ বাগান উজাড় করে চা বাগান করেছিলো। এক সময়ের পতিত থাকা জমি হয়ে উঠেছে বিস্তৃত চা বাগান। বাড়ির আঙিনা থেকে শুরু করে সড়কের ধারে উচু-নিচু পতিত জমিতে কিংবা পুকুরপাড়ে এমনকি বাড়ির আঙিনায় রয়েছে চা-বাগান করেছেন ক্ষুদ্র চাষিরা। চা শিল্প ঘিরে সুখের স্বপ্ন দেখলেও পাতার দাম না থাকায় ক্ষুদ্র চাষীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে হতাশা। কৃষকরা অভিযোগ করছেন, চা পাতার দরপতনের পিছনে এক শক্তিশালী সিন্ডিকেট কাজ করছে। এ সিন্ডিকেটের মধ্যে স্থানীয়ভাবে গড়ে উঠা চা কারখানাগুলোর মালিকরা। চা পাতার মূল্য বৃদ্ধির দাবিতে কয়েক বছর ধরেই রাজপথে আন্দোলন করে আসছে চাষীরা। কয়েকদফা মানববন্ধনও করে তারা। কিন্তু কর্তৃপক্ষের টনক নড়েনি।

তেলিপাড়ার এলাকার চা চাষি আহসান হাবীব জানান, ২ একর জমিতে চা চাষ করেছি। হঠাৎ করেই চা কারখানা মালিকরা নীলকরদের মতো আমাদের উপর অত্যাচার শুরু করেছে। কাঁচা চা পাতা কেজিতে ১১টায় এসেছে। তার মধ্যে ১৫-২০% পর্যন্ত কারখানাগুলো কর্তন করে নিচ্ছে। এই মূল্যে মুজুরীর দাম তো উঠছেই না, সার-কীটনাশের দাম তো রয়েছে। প্রতি কেজি চা পাতার খরচ ১৪ টাকার মতো পড়ে। যার কারণে ঘর থেকে এখন লোকসান গুনতে হচ্ছে। চায়ের ন্যায্য মূল্যের দাবিতে বুধবার বিকেলে মানববন্ধন ডাক দেয়া হয়েছে।

শারিয়ালজোত গ্রামের চা চাষী নুরুল ইসলাম জানান, এখন উভয় সংকটে পড়েছি। চা পাতার দামতো নাই-তার মধ্যে বাজারে পটাশ সার পাওয়া যাচ্ছে না। কারখানা মালিকদের গভীর ষড়যন্ত্রে এলাকার কিছু প্রভাবশালী অসাধু চা চাষী এবং চা ব্যবসায়ী হাত মিলিয়েছে। তাদের চা পাতার দাম মিললেও আমাদের মতো ক্ষুদ্র চা চাষীদের চা পাতার ন্যায্য মূল্য মিলছে না।

দর্জিপাড়া এলাকার কামাল, হামিদ ও করিম জানান, চা পাতার দাম না পাওয়ায় কামলার (শ্রমিক) মুজুরী ও সার-কীটনাশকের দামও উঠছে না পাতা বিক্রি করে। কী করবো বুঝতে পারছি না। এ অবস্থায় মূল্য না থাকায় চরম লোকসানে পড়তে হচ্ছে। আমাদের মতো ক্ষুদ্র চা চাষিরা হতাশ হয়ে পড়েছে। চা চাষীদের মাঠে মারা যাওয়ার অবস্থা তৈরি হয়েছে।

চা-চাষি আলমগীর হোসেন বলেন, হঠাৎ করে চা-পাতার দাম ২২ টাকা থেকে ১১ টাকায় নেমে আসায় তেমন আর লাভ হচ্ছে না। একেক দিন একেক দামে চা-পাতা কেনে কারখানাগুলো। এ ছাড়া চা-পাতা নেয়ার পর তারা বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে ১৫-২০ শতাংশ কেটে নেয়।

কিন্তু চা কারখানা মালিকরা অন্য কথা। তারা বলছেন, ক্ষুদ্র চাষিরা কাঁচাপাতা তুলতে সঠিক নিয়ম না মানায় কমে গেছে চায়ের মান। তাই অকশন মার্কেটে প্রস্তুতকৃত চা যাওয়ার কারণে কমেছে কাঁচা চা পাতার দামও। কাঁচা চা পাতার দাম বাড়ানোর জন্য চাষিদের নিয়ম মেনে তা সংগ্রহ ও ভালো চারা রোপণের পরামর্শ দিচ্ছে টি-বোর্ড। এখন চলমান চা পাতার দরপতনের অচলাবস্থা দূর হবে কি না এমন আশঙ্কায় প্রহর পোহাচ্ছেন চাষিরা।

গ্রিন কেয়ার চা কারখানার ম্যানেজার মঞ্জুরুল আলম মঞ্জু বলেন, ‘চা চাষে কৃষকদের পাশাপাশি শ্রমিক ও বেকারদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। চাষিরা ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না, এটি সত্য নয়। চা-পাতার দাম অকশন বাজারের ওপর নির্ভর করে। এক কেজি চায়ের অর্ধেক পাবে কৃষক আর অর্ধেক পাবে কারখানা। সেই অনুযায়ী চায়ের মূল্য নির্ধারণ হয়।’বিশেষ করে চা পাতা তোলার নিয়ম হচ্ছে হাতে তোলা। এক কুঁড়ির তিন পাতা পর্যন্ত। কিন্তু এখানকার চাষিরা ৫-৭ পাতা পর্যন্ত নিয়ে আসছে কারখানায়। যার কারণে চায়ের মান খারাপ হলে মূল্য হ্রাস ঘটছে।

এ বিষয়ে নর্দান বাংলাদেশ চা বোর্ড পঞ্চগড়ের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও প্রকল্প পরিচালক ডা. মোহাম্মদ শামীম আল মামুন বলেন, ‘পঞ্চগড়ের চা দেশের বিভিন্ন জেলাসহ বিদেশেও রপ্তানি হয়। চা-চাষিদের আমরা সকল প্রকার সেবা ও পরামর্শ দিচ্ছি। নিলাম বাজারে এখানকার চায়ের দাম কমায় কাঁচা পাতার দামে প্রভাব পড়েছে। চা উৎপাদনে গুণগত মান রক্ষা করতে পারলে এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব। বিশেষ করে কৃষকদের হতাশা বিষয়ে জেলা প্রশাসক মহোদয় অবগত রয়েছেন। আশা করছি দু’য়েক সপ্তাহের মধ্যে চা পাতার মূল্য নির্ধারণ করা হবে।

মন্তব্য ( ০)





  • company_logo