• বিশেষ প্রতিবেদন
  • লিড নিউজ

বিদ্যুৎ পাচ্ছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চলের ৮ হাজার পরিবার

  • বিশেষ প্রতিবেদন
  • লিড নিউজ
  • ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১৯:২৪:১২

ছবিঃ সিএনআই

চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধিঃ পদ্মা নদী পার হতে নৌপথেই সময় লাগে ঘন্টা খানেকের বেশি। পদ্মা পেরিয়ে একটি বিছিন্ন জনপথ সীমান্ত ঘেঁষা চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর ও শিবগঞ্জ উপজেলার চরাঞ্চল। সেখানকার মানুষ এখনও জানে না বিদ্যুতের ব্যবহার। বঞ্চিত বিদ্যুতের সকল ব্যবহার থেকে। এখানকার পরিবেশ ও জীবনযাপন দেখে মনে হবে এটি এক অন্য বাংলাদেশের চিত্র। এবার পাল্টে যাচ্ছে সেই চিত্র। ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকা চাঁপাইনবাবগঞ্জের ৫টি ইউনিয়নের প্রায় ৮ হাজার পরিবার এবার বিদুৎ সেবার আওতায় আসছে। 

সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে পদ্মা নদীর তলদেশ দিয়ে বিদুৎ সংযোগ যাবে বিছিন্ন চরাঞ্চলে। সংযোগ দেয়ার পরপরই প্রাথমিকভাবে উজিরপুর ইউনিয়নের ১টি, দুর্লভপুরের ১টি, নারায়নপুরের ৮টি  ওয়ার্ড এবং সুন্দরপুর ও পাঁকা ইউনিয়নের কিছু অংশ মিলে মোট ২৮টি গ্রামের ৪০ হাজার মানুষ বিদুৎ সেবার আওতায় আসবে। ইতোমধ্যে ১০৭ কিলোমিটারের মধ্যে দীর্ঘ ৯০ কিলোমিটার বৈদ্যুতিক তারের সংযোগ সম্পন্ন করা হয়েছে। পদ্মা নদীর তলদেশ দিয়ে বৈদ্যুতিক তার পরিবহনের জন্য সাবমেরিন কেবল নদী পাড়ে নিয়ে আসা হয়েছে। 

স্থানীয় বাসিন্দা, জনপ্রতিনিধি ও পল্লী বিদুৎ সমিতি বলছে, দীর্ঘদিনের অপেক্ষার অবসান হতে যাচ্ছে চরাঞ্চলবাসীর। সীমান্ত ঘেঁষা চরাঞ্চলে বিদুৎ সেবা একটি বড় মাইলফলক হতে যাচ্ছে। বিদুৎ সুবিধার ফলে এই অঞ্চলের অনুন্নত জনপদে আসবে বৈকল্পিক পরিবর্তন। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ছাড়াও কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, চিকিৎসায় উন্নয়ন ঘটবে। সেই সাথে বাড়বে সামাজিক উন্নয়ন। ইতোমধ্যেই বাড়ির সামনে পর্যন্ত বৈদুতিক পোল ও তার সংযোগ দেয়া সম্পন্ন করা হয়েছে। 

এই চরাঞ্চলে বর্তমানে সোলার প্যানেলই একমাত্র ভরসা। তবে সিংগভাগ খেটে-খাওয়া অসহায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বসবাস হওয়ায় হাতেগোনা কিছু পরিবার ছাড়া কোথাও সোলারের ব্যবহার নেই। বাধ্য হয়েই অন্ধকারে বসবাস করতে হয় সীমান্তবর্তী এলাকার হাজারো মানুষকে। ইতোমধ্যে সদর উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের হায়াত মোড়ে সাব-স্টেশন নির্মাণের কাজ শেষ করা হয়েছে। 

নারায়নপুর দারুল আলিম মাদরাসায় আলিম প্রথম বর্ষের ছাত্র আব্দুল আলিম বলেন, ঝড়বৃষ্টি হলেই আমরা ক্লাস করতে পারি না। মাদরাসায় একটি কম্পিউটার আছে, দু-এক দিন রোদ না উঠলে কম্পিউটার ক্লাস করতে পারিনা। গরমের সময় ক্লাস করতে গিয়ে অনেক ছাত্রছাত্রী আহত হয়ে যায়। এমনকি গ্রীষ্মের সময় বিরতি দিয়েও ক্লাস করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। বিদুতের সংযোগ আসলে এসব সমস্যা থেকে উত্তোরণ মিলবে৷ বিদুৎ পেলে ফ্যান, কম্পিউটার চালু থাকবে। আমাদের পড়াশোনার গতিও বাড়বে। 

কৃষক মো. ইব্রাহিম আলী জানান, চরাঞ্চলে বিদুৎ না থাকায় নানারকম অসুবিধার মধ্যে পড়তে হয়। এক বিঘা ধান চাষ করতে ১০-১২ হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়। বিদুৎ সুবিধা পেলে কৃষি খাতে খরচ অর্ধেকে নেমে আসবে। এক কেজির বেশি মাংস কিনতে পারিনা। কারন এখানে ফ্রিজের কোন সুবিধা নাই। চরাঞ্চলের মানুষের একটি বড় সমস্যা মোবাইল চার্জ করা নিয়ে। হাতেগোনা কয়েকটা বাড়িতে সোলার আছে। তাই প্রতিদিন মোবাইল চার্জ করা নিয়ে বাড়ি বাড়ি দৌড়াতে হয়। 

চরপাঁকা মসজিদের ইমাম মাওলানা মোহাম্মদ সেতাউর রহমান বলেন, এখানে বিদুৎ আসলে এই অঞ্চলের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটবে। গরমের সময় মসজিদে মুসল্লীরা সঠিকভাবে ধীরেসুস্থে নামাজ আদায় করতে পারে না। মুসল্লীদের শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় দ্রুত নামাজ শেষ করতে হয়। বিদুৎ আসলে ফ্যানের বাতাসে সঠিকভাবে ঠান্ডা মস্তিষ্কে, তৃপ্তি সহকারে নামাজ আদায় করতে পারবো। 

স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মী মিমিয়ারা খাতুন জানান, চরাঞ্চলে একদিকে যেমন গাছপালা কম, তেমনি অন্যদিকে শতভাগ বাড়িঘর টিনের তৈরি। তাই গরম অনেক বেশি। এছাড়াও রান্নার কাজে ও খাবার পানি হিসেবে নদীর পানিই একমাত্র ভরসা। কিন্তু বিদ্যুৎ সুবিধা থাকলে মটারের মাধ্যমে নিরাপদ পানি খেতে পেতাম। ছেলেমেয়েরা সন্ধ্যার পর পড়াশোনা করতে পারেনা। আমরা কোনদিন ভাবিনি যে, পদ্মার চরে বিদ্যুৎ সেবা আসবে। এই কাজের জন্য আমরা অনেক বেশি উৎসাহিত ও আনন্দিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা এমন উদ্যোগ নেয়ার জন্য। 

মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্মলীগ পাঁকা ইউনিয়ন শাখার সভাপতি এসএম আলামিন জুয়েল জানান, জন্মের পর থেকেই আমরা অন্ধকারের মধ্যে ছিলাম। মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদেরকে আলো দেখিয়েছেন। জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমরা চিরকৃতজ্ঞ থাকবো। আমরা কোনদিন কল্পনাও করতে পারিনি যে, চরাঞ্চলে বিদুৎ সুবিধা আসবে। এই অঞ্চলের ১০ শতাংশ মানুষও বিদুতের ব্যবহার জানেনা। এখানে বিদুৎ আসলে বেকারত্ব কমার পাশাপাশি সব খাতেই উন্নয়ন হবে। 

পাঁকা ইউনিয়ন পরিষদের ০৮ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য তরিকুল ইসলাম বলেন, চরাঞ্চলে বিদুৎ সুবিধা আসবে, এটা আমাদের স্বপ্নের বাইরে। দেশনায়ক শেখ হাসিনার দুটি যুগান্তকারী উদ্যোগে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। গৃহহীনদের জন্য ঘর নির্মাণ ও বিদুতের উন্নয়ন দেশকে অন্যন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। আমরা জানি, উন্নয়নের প্রধান নিয়ামক হলো বিদুৎ। এই প্রকল্পে কোন অনিয়ম না করতে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি দেয়ার আহ্বান জানান তিনি।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ পল্লী বিদুৎ সমিতির সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম জানান, "প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগ, ঘরে ঘরে বিদুৎ" এই স্লোগান বাস্তবায়নে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ২৮টি সীমান্তবর্তী গ্রামে প্রাথমিকভাবে ৭৪০০ পরিবার বিদুৎ সরবরাহ পাবে। বর্তমানে অফগ্রীডের কাজ চলমান রয়েছে। বৈদ্যুতিক লাইনের কাজ শেষ হয়েছে। সদর উপজেলার মিরের চর এলাকায় ৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ সাবমেরিন রাখা হয়েছে। এছাড়াও পাঁকা থেকে নারায়নপুরের জন্য আরও ২০ কিলোমিটার সাবমেরিন আসবে। বর্তমানে পদ্মায় প্রচুর স্রোত, তাই এটি কমতে শুরু করলে খুব শীগ্রই সাবমেরিন স্থাপনের কাজ শুরু হবে। 

চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য ডা. শামিল উদ্দিন আহমেদ শিমুল বলেন,  বাংলাদেশের কোন প্রতন্ত এলাকা বিদুৎবিহীন থাকবে না, প্রধানমন্ত্রীর এমন উদ্যোগের ফলে চরাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা পাল্টে যাবে। চরাঞ্চলে বিদুৎ সুবিধা হলে এখানকার যাতায়াত ব্যবস্থা, তথ্য-প্রযুক্তি খাত উন্নয়ন হবে এবং কর্মসংস্থান বাড়বে। শতভাগ বিদুৎতায়নের লক্ষ্যমাত্রা পূরনে এই প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বিদ্যুতের ফলে জীবনযাত্রা পাল্টে যাবে চরাঞ্চলবাসীর। 

উল্লেখ্য, প্রকল্পটির মেয়াদ ধরা হয়েছিল চলতি বছরের ৩০ জুন। তবে পদ্মায় অতিরিক্ত পানি প্রবাহ ও স্রোত থাকায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়াতে হয়েছে বলে জানিয়েছে পল্লী বিদুৎ সমিতি। 

মন্তব্য ( ০)





  • company_logo