• বিশেষ প্রতিবেদন

শেরপুরে অবহেলায় বিলীনের পথে কালের সাক্ষী বেড় শিমুল গাছ, ঐতিহ্য রক্ষায় নেই স্থানীয় উদ্যোগ  

  • বিশেষ প্রতিবেদন
  • ২৪ জুন, ২০২১ ১৪:৩৬:০২

ছবিঃ সিএনআই

শেরপুর প্রতিনিধিঃ ‘বেড় শিমুল গাছ’ শেরপুরের যুগ যুগ আর কালের সাক্ষী হিসেবে পরিচিত এক প্রাচীন বৃক্ষ। নকলা উপজেলার নারায়ণখোলা এলাকায় প্রায় এক বিঘা জমিজুড়ে অবস্থিত জেলার ওই বৃহত্তম গাছটি ঘিরে নানান ইতিহাস আর কল্পকথা ছড়িয়ে থাকলেও তা রক্ষায় নেই কোন স্থানীয় উদ্যোগ। ফলে অযত্নে  অবহেলায় আজ অস্তিত্ব বিলীনের হুমকির মুখে ওই বেড় শিমুল গাছটি। অথচ একটি সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করে অবাধ জনযাতায়াত নিয়ন্ত্রণ এবং বৈজ্ঞানিক উপায়ে এটি রক্ষা করা গেলে জেলার দর্শনীয় স্থান ও পর্যটনে যোগ হতো নতুন মাত্রা। এ সুবাদে দূর-দূরান্তের আরও অধিক পর্যটকদের আনাগোনায় বেড়ে যেতো এলাকার পরিচিতি।

জানা যায়, নকলা উপজেলার চরঅষ্টধর ইউনিয়নের পল্লী হলেও একটি প্রসিদ্ধ এলাকার নাম নারায়ণখোলা। কৃষিসমৃদ্ধ ওই এলাকায় বহুল আলোচিত ঐতিহাসিক বেড় শিমুল গাছটির আনুমানিক বয়স কতো তা কেউ ধারণা দিতে পারে না। এলাকার প্রবীণ ও বয়োবৃদ্ধদের ভাষ্য অনুযায়ী, তারা ছোটকাল থেকেই গাছটিকে ওই অবস্থায় দেখে আসছেন। তাদের কেউ কেউ পূর্ব পুরুষদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী বলছেন, গাছটির বয়স ৩শ বছরের কম হবে না। আবার কেউ কেউ বলছেন, তার বয়স হবে ৫শ বছর। আর গাছটি দেখতে কিরকম তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করানোই কঠিন। 

প্রায় এক বিঘা জমির জায়গাজুড়ে অবস্থান গাছটির। গাছের কান্ডের পশ্চিম পাশে হাতি এবং উত্তর পাশে নৌকার বৈঠা ও সাপ সদৃশ্য। প্রায় ৪২ গজ ব্যাসের ওই গাছটির উচ্চতা প্রায় ১০০ ফুট। তবে গাছের গোড়া থেকে চারপাশে বেরিয়ে যাওয়া ১০/১২টি বেড়সহ শাখা ডাল রয়েছে অসংখ্য। তার যে কোন একটি শাখা ধরে নাড়া দিলে সমগ্র গাছ নড়ে ওঠে। একসময় বেড়শিমুল গাছটি এতটাই ঘন ছিল যে, এর নিচে রোদ, বৃষ্টি, কুয়াশা কিছুই পড়ত না। প্রচন্ড গরমের সময়ও গাছের নিচে থাকত ঠান্ডা। পথিক, কৃষক থেকে শুরু করে নানা পেশা-বয়সি লোকজন গাছের তলায় শুয়ে-বসে বিশ্রাম নিত। দুপুর ও বিকেলে দেখা যেত ডালে ডালে শুয়ে ঘুমাচ্ছে মানুষ। গাছটি যার জমিতে আছে তিনি তার বাবার পৈত্রিক সম্পত্তি হিসেবে পেয়েছেন। আর এভাবেই পূর্বপুরুষদের হাতবদল হয়েই চলমান আছেন জায়গাটি।

এদিকে, এখন অযত্ন আর অবহেলায় বিশালাকার প্রাচীন ওই গাছটির অস্তিত্ হুমকির সম্মুখীন হলেও চারদিক খোলামেলা হওয়ায় ওই গাছজুড়ে থাকা এলাকাটি পিকনিক স্পট হিসেবেও পেয়েছে পরিচিতি। প্রতিদিন তা দেখতে বিভিন্ন এলাকার লোকজন ছুটে আসছেন। অনেকেই আগ্রহ ভরে জানতে চাচ্ছেন তার জন্মকথা ও ইতিহাস। সেইসাথে স্থানীয়দের কাছ থেকে শুনছেন গাছটি ঘিরে

থাকা নানা কল্পকথা। আবার অনেকেই শখের বশে তুলে নিচ্ছেন গাছের ছবি এবং গাছের সাথে নিজেকে জড়িয়ে তুলছেন সেলফি। কেবল তাই নয়, একসময় ওই
শিমুল গাছের নিচে চলচ্চিত্রের শ্যুটিংও দেখেছে এলাকাবাসী। খ্যাতিমান অভিনেতা অমিত হাসান, আলীরাজ, আনোয়ারা বেগম, চিত্রনায়ক জয়, জাবেদসহ আরো অনেকেই এখানে শ্যুটিং করার জন্য এসেছেন।

এলাকায় জন শ্রুতি রয়েছে, অনেকদিন আগে গাছটি বিক্রি করা হয়েছিলো। এরপর কিনে নেওয়া ব্যক্তির লোকজন গাছের একটি ডাল কাটতেই তাদের নাক ও মুখ দিয়ে রক্ত আসতে শুরু করে। তারপর থেকে গাছের মালিক আর গাছ বিক্রি করেনি, কেউ কিনতেও আসে না। এছাড়া আরও জনশ্রæতি আছে যে, একসময় গরিব- দুঃখীর বিয়ের সময় নাকি বিবাহের কথা বললে, কাসার থালা, বাসন, ঘটি-বাটি ইত্যাদি কিছুক্ষণ পর গাছের নিচে পাওয়া যেতো। আবার কাজ শেষে সমস্ত জিনিস ফেরত দিতে হতো। যদি কেউ লোভ করে দুই/একটা জিনিস রেখে দিতো, তবে অদৃশ্যভাবে তাদের ভয়-ভীতি দেখানো হতো। তাই মানুষের লোভের কারণেই নাকি ওইসব জিনিস দেয়া বন্ধ হয়ে গেছে। জীবনের চলার পথে আপদে-বিপদে এই গাছের নিচে মান্নত করলেও নাকি উপকার পাওয়া যেতো।

সরেজমিনে গেলে কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দা আব্বাস আলী ও শামসুল হকসহ কয়েকজনের সাথে। আব্বাস আলী জানান, তিনি বাপ-দাদার কাছ থেকে শুনে আসছেন ওই বেড় শিমুল গাছের বয়স কমপক্ষে ৩শ বছর হবে। তবে কেউ কেউ তার দ্বিমত পোষণ করে গাছটির বয়স প্রায় ৫শ বছর হবে বলেও দাবি করে থাকেন। তার
মতে, প্রশাসনের অযত্ন-অবহেলা, রক্ষণাবেক্ষণের অভাব ও নানামুখী অত্যাচারে কারণে ঐতিহ্যবাহী বেড়শিমুল গাছটি অস্তিত্ব বিলীনের হুমকিতে পড়েছে। মারা
যাচ্ছে অনেক উপবৃক্ষ। ভেঙে পড়ছে বড় বড় ডালগুলো। আর শামসুল হক জানান, কালের সাক্ষী হয়ে থাকা কেবল নকলা নয়, সম্ভবত দেশের সর্বাধিক প্রাচীন ও
ঐতিহাসিক ওই বিশালাকার বেড় শিমুল গাছটি স্থানীয়ভাবে রক্ষার জন্য ইতোপূর্বে জেলা পরিষদ ও উপজেলা পরিষদের তরফ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হলেও তার আর বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে গাছটির চারপাশে নেই কোন সীমানা প্রাচীর।

এছাড়া দূর-দূরান্ত থেকে আসা পর্যটকদের জন্যও নেই কোন বসার বা বিশ্রামের ব্যবস্থা। তার মতে, প্রাচীন এই গাছটি বৈজ্ঞানিক উপায়ে রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারলে শেরপুরের পর্যটনে যোগ হবে নতুন মাত্রা, বাড়বে পর্যটকদের আনাগোনা। এ ব্যাপারে স্থানীয় চরঅষ্টধর ইউপি চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ গোলাম রব্বানী জানান, বিশাল আকৃতির ওই বেড় শিমুল গাছটির এ অঞ্চলে কালের সাক্ষী হয়ে আজও তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। এটি রক্ষায় ইতোমধ্যে উপজেলা পরিষদের তরফ থেকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য দাবি জানানো হয়েছে। আশা রাখছি আগামী অর্থবছরে সেখানে একটি সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ, দর্শনার্থীদের বসার ব্যবস্থা ও টয়লেট নির্মাণ হলে সুন্দর পরিবেশ ফিরে আসবে।

মন্তব্য ( ০)





  • company_logo