• অপরাধ ও দুর্নীতি

সম্পত্তির লোভে মঞ্জিলকে নৃশংসভাবে হত্যা, জড়িত পুরো পরিবার

  • অপরাধ ও দুর্নীতি
  • ১৪ জুন, ২০২১ ১৩:৩১:৪০

ছবিঃ সিএনআই

নুরুল আমিন হাসান : রাজধানীর আফতাবনগরে সম্পত্তির লোভে একেএম মনজিল হককে ভাড়াটে খুনি দিয়ে নৃশংসভাবে ভাবে হত্যা করা হয়েছে। এ হত্যাকান্ডে জড়িত পুরো পরিবার। অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) জানায়, মঞ্জিল হককে ধারালো ছুরি দিয়ে জবাই করা হয়। তারপর পেটে ছুরিকাঘাত এবং দুই হাতের রগ ও পায়ের রগ কেটে নিশংসভাবে খুন করা হয়।

আফতাবনগরের পৈত্রিক ফ্লাটে ২০১৭ সালের ১১ ডিসেম্বর বেলা সোয়া ১১টার দিকে অজ্ঞাতনামা চারজন দুষ্কৃতিকারীর ধারালো অস্ত্রের আঘাতে খুন হন একেএম মনজিলল হক। হত্যাকান্ডের চার বছর পর সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগে রাজধানীর জুরাইন রেলগেট থেকে সীমান্ত হাসান তাকদীর-কে শনিবার (১২ জুন) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় গ্রেফতার করা হয়। এর আগে হত্যাকান্ডের পর নিখোঁজ ইয়াছিন হককে চট্টগ্রাম মহানগরীর শেরশাহ কলোনী এলাকা থেকে গত ১৩ মার্চ, পরের দিন ঢাকাস্থ কোনাপাড়া এলাকা থেকে ভাড়াটে খুনি রবিউল ইসলাম সিয়ামকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের দেওয়া তথ্যমতে রাজধানীর ডেমরায় এলাকা থেকে গত ৮ এপ্রিল মাহফুজুল ইসলাম রাকিবকে গ্রেফতার করে সিআইডি।

রাজধানীর মালিবাগের সিআইডির প্রধান কার্যালয়ে রোববার (১৩ জুন) দুপুরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন সংস্থাটির অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক।

সিআইডি'র এই কর্মকর্তা বলেন- 'হত্যাকান্ডের আগের দিন গত ২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর ভাড়াটে তিন খুনি ইয়াসিন হকের বনশ্রীস্থ পৈত্রিক ফ্ল্যাটে রাত্রি যাপন করে। ইয়াসিন হকের মা লায়লা ইয়াসমিন লিপি, মামলার বাদী ফারুক মিয়া ও ইয়াসিন হকের মামা আবু ইউসুফ নয়ন ভাড়াটে খুনীদের সরদার রবিউল ইসলাম সিয়াম-কে নিয়ে গোপন বৈঠক করে এবং বিভিন্ন দিক নির্দেশনা প্রদান করেন। সেই সাথে খুনের জন্য ভাড়াটিয়ে খুনিদের সাথে ৫ লাখ টাকা চুক্তি করেন। পরবর্তীতে ফোনের কাজে ব্যয় করার জন্য নগদ ২০ হাজার টাকা ভাড়াটিয়ে খুনিদের দেওয়া হয়। আর বলা হয়, খুনের পর বাকি টাকা দেওয়া হবে। 

ভাড়াটে খুনি রবিউল ইসলাম সিয়াম, মাহফুজুল ইসলাম রাকিব ও সীমান্ত হাসান তাকবির-দের সহযোগিতায় পৈত্রিক সম্পত্তির লোভে ইয়াসিন হক, তার মা লায়লা ইয়াসমিন লিপি, মামা আবু ইউসুফ নয়ন এবং মামলার বাদী ফারুক মিয়ার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্ররোচনায় মনজিল হক-কে খুন করেছে বলে তদন্তকালে জানা যায়। 

ওই টাকা দিয়ে ইয়াসিন ভাড়াটে খুনিদের সরদার রবিউল ইসলাম সিয়াম-কে নিয়ে হত্যার ৮/১০ দিন আগে নিউমার্কেটের ফুটপাত হতে খুনের কাজে ব্যবহারের জন্য দুটি ধারালো চাকু, পাটের রশি এবং এগুলো বহনের জন্য একটি রেকসিনের ব্যাগ ক্রয় করে। হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত চাকু, রেকসিনের ব্যাগ ও রশি এবং খুনিদের ফেলে যাওয়া রক্তমাখা কাপড়-চোপড় সিআইডি ডিএনএ ল্যাবের মাধ্যমে পরীক্ষা করা হয়। তাতে ৫ জন পুরুষ ব্যক্তির উপস্থিতি পাওয়া যায়।

হত্যাকান্ডের বিষয়টি ধামাচাপার চেষ্টা প্রসঙ্গে অতিরিক্ত ডিআইজি বলেন, মামলার ডিজিষ্ট মনজিল হকের চাচা ফারুক মিয়া বাদী হয়ে ওই দিনই বাড্ডা থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। থানা পুলিশের তদন্তাধীন অবস্থায় সিআইডি কর্তৃক তদন্তের সুপারিশসহ ডিএমপি কর্তৃপক্ষের প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের আদেশে ২০১৮ সালের ২৪ মার্চ তদন্তভার পায় সিআইডি। 

সিআইডির তদন্ত চলাকালে মামলাটির বাদী ও ভুক্তভোগীর চাচা প্রথম থেকেই তদন্তে অসহযোগীতা করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য প্রভাবিত করে আসছিলেন। এদিকে ভুক্তভোগী মনজিল হকের সৎ ভাই একেএম ইয়াছিন হক তাকে হত্যার পর থেকেই নিখোঁজ। এ ঘটনায় ইয়াছিন হকের মামা আবু ইউসুফ নয়ন মনজিল হত্যার তিন দিন পর রামপুরা থানায় একটি সাধারন ডাইরী করেন। নিখোঁজ একেএম ইয়াসিন হক-এর সন্ধান না পাওয়ায় ভুক্তভোগী একেএম মনজিল হক খুন হওয়ার কোন সূত্র খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। অজ্ঞাতনামা খুনিরা নিখোঁজ ইয়াছিন হক-কে অপহরণপূর্বক খুন করে লাশ গুম করেছে মর্মে বাদী মিথ্যা তথ্য দিয়ে সিআইডিকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। 

আসামীদের গ্রেফতার প্রসঙ্গে অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক বলেন- বিশ্বস্ত গুপ্তচরের মাধ্যমে জানা যায় যে, নিখোঁজ ইয়াছিন হক প্রকৃত নাম গোপন করে ছদ্ম নাম ব্যবহার করে চট্টগ্রাম মহানগরী এলাকায় দৈনিক জাগরনী পত্রিকার জেলা রিপোর্টার হিসেবে কাজ করছে। সে সূত্র ধরে তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে তাকে মহানগরীর শেরশাহ কলোনী এলাকা হতে ১৩ মার্চ গ্রেফতার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের তার তথ্যমতে ভাড়াটে খুনী রবিউল ইসলাম সিয়াম-কে ঢাকাস্থ কোনাপাড়া এলাকা থেকে পরেদিন গ্রেফতার করা হয়।

গ্রেফতার হওয়া দুই জন বিজ্ঞ আদালতে ১৬৪ ধারা জবানবন্দিতে বলেন, আসামী ইয়াসিন হক পৈত্রিক সম্পত্তির লোভে ভাড়াটে তিন জন খুনির সহযোগিতায় মনজিল হক-কে খুন করেছে। তাদের দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ভিত্তিতে গত ৮ এপ্রিল রাজধানীর ডেমরা থেকে মাহফুজুল ইসলাম রাকিবকে গ্রেফতার করা হয়। রাকিবও বিজ্ঞ আদালতে খুনের ঘটনার সাথে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে ফৌঃকাঃবিঃ আইনের ১৬৪ ধারা মতে স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দি প্রদান করে। গ্রেফতার হওয়া তিন জনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ভিত্তিতে রাজধানীর জুরাইন রেলগেট এলাকা থেকে শনিবার (১২ জুন) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় সীমান্ত হাসান তাকবীরকে গ্রেফতার করা হয়। 

সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদকালে সীমান্ত হাসান তাকবীর মনজিল হত্যাকান্ডের সাথে সরাসরি জড়িত ছিল এবং নিজের দোষ স্বীকার করে স্বেচ্ছায় বিজ্ঞ আদালতে জবানবন্দী প্রদানে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

অপরদিকে গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, সম্পত্তির লোভে মনজিল হককে ধারালো ছুরি দ্বারা জবাই করে, পেটে স্ট্যাব করে এবং দুই হাতের রগ ও পায়ের রগ কেটে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে।

তিনি বলেন, আসামী ইয়াসিন হক মনজিলকে খুন করার পর তার রক্তমাখা কাপড়-চোপড় আফতাব নগরস্থ খালে ফেলেছে বলে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উল্লেখ করে। অন্যান্য ভাড়াটে খুনিরা তাদের রক্তমাখা কাপড়-চোপড় ঘটনাস্থলে ফেলে তারা নিহত মনজিল হকের ব্যবহৃত কাপড়-চোপড় পড়ে পালিয়ে যায়। 

শেখ ওমর ফারুক বলেন, মামলা তদন্তকালে আরো জানা যায় যে, মনজিলের বয়স যখন ৩/৪ বছর, তখন মনজিলের পিতার সাথে তার খালাত শ্যালিকা লায়লা ইয়াসমিন লিপির প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। এক পর্যায়ে লায়লা ইয়াসমিন লিপির প্ররোচনায় মনজিলের পিতা মইনুল হক ওরফে মনা তার শান্তিনগরের বাসায় মনজিলের মা সাদিয়া পারভীন কাজলের গায়ে কোরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৩ দিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে মনজিলের মা সাদিয়া পারভীন কাজল মৃত্যুবরণ করেন। 

মনজিলের পিতা গ্যাসের চুলা থেকে মনজিলের মায়ের পরনে থাকা গায়ের কাপড়ে আগুন ধরে মৃত্যু হয়েছে বলে চালিয়ে দেয়। মনজিলের মায়ের মৃত্যুর পরের বছর মনজিলের পিতা মনা তার প্রেমিকা লায়লা ইয়াসমিন লিপিকে দ্বিতীয় বিবাহ করে ঘরসংসার শুরু করে।

এদিকে মনজিল, ইয়াসিন এবং ফারুক মিয়ার ছেলে একেএম নেওয়াজ এর নামে শান্তিনগর বাজারের পিছনে যৌথ মালিকানার একটি ফ্ল্যাট ছিল। ওই ফ্ল্যাটে মনজিলের মা ও মনজিলকে নিয়ে প্রথমে বসবাস করতেন। দ্বিতীয় বিয়ের পর মনজিলের পিতা মনা, মনজিল, তার সৎ মা লায়লা ইয়াসমিন লিপি ও লিপি’র ঔরশজাত সন্তান একে এম ইয়াসিনকে নিয়ে বসবাস করতেন। ইয়াসিনের বয়স যখন ১২/১৩ বছর তখন মনজিলের বাবা উক্ত ফ্ল্যাটটি ইয়াসিন ও মনজিলকে দিয়ে দলিল করিয়ে গোপনে বিক্রি করে দেয়। ফারুক মিয়া তার ছেলের নামের ফ্ল্যাট বিক্রির টাকা চাইলে মনজিল ও মনজিলের পিতা ফারুক মিয়াকে মাদকাসক্ত বলে প্রচার করে বাড্ডাস্থ সেতু নামক একটি মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে ২ মাস ২১ দিন আটকে রাখে। 

ফারুক মিয়ার লন্ডন প্রবাসি ছেলে একেএম নেওয়াজ ও তার মেয়ের জামাই আইন শৃংখলা বাহিনীর সহায়তায় ফারুক মিয়াকে উদ্ধার করে। এ ব্যাপারে ফারুক মিয়া কোন মামলা করেনি। উক্ত ক্ষোভের বশীভুত হয়ে ফারুক মিয়া তার ভাতিজা ইয়াসিন ও ভাড়াটে তিন খুনি দিয়ে মনজিলকে হত্যার পরিকল্পনার করে বলে মামলাটির গোপনীয় তদন্ত ও সাক্ষ্য প্রমানে জানা যায়।

তদন্তকালে আরো জানা যায় যে, মনজিল তার পিতার নিকট জানতে পারে তার মৃত মায়ের স্বর্ণালংকার তার সৎ মা লায়লা ইয়াসমিন লিপির নিকট আছে। মনজিলের পিতার মৃত্যুর পর মনজিল তার সৎ মা লায়লা ইয়াসমিন লিপির নিকট তার মায়েল গহনাগুলো চাইলে লায়লা ইয়াসমিন লিপি মনজিলকে জানায় যে, উক্ত স্বর্ণালংকার তার ভাই আবু ইউসুফ নয়নের নিকট আছে। মনজিল আবু ইউসুফ নয়নের সাথে কথা বলে নিশ্চিত হয়ে তার মায়ের গহনাগুলো ফেরত দেয়ার জন্য বারবার অনুরোধ করলেও আবু ইউসুফ নয়ন গহনাগুলো ফেরত না দিয়ে সময়ক্ষেপন করতে থাকে। কিছুদিন পর মনজিল তার কয়েকজন বন্ধু নিয়ে তার সৎ মা লায়লা ইয়াসমিন লিপির ভাই সিদ্দিকের রাজারবাগের বাসায় আবু ইউসুফ নয়নকে পেয়ে তার মায়ের স্বর্ণালংকার ফেরত না দেয়ায় নয়নকে লাঞ্ছিত করে। 

ইয়াসিন তার সৎ ভাই ডিজিস্ট মনজিলকে হত্যার পরিকল্পনার বিষয়ে আবু ইউসুফ নয়নের সাথে পরামর্শ করলে নয়ন গহনা ইস্যুতে ক্ষোভের কারণে ইয়াসিনের প্রস্তাবে সম্মতি দেয়। সেই সাথে হত্যার কাজে খরচ করার জন্য ইয়াসিনকে ২০ হাজার টাকা দেয় বলে ইয়াসিন স্বীকরোক্তিমূলক জবানবন্দীতে প্রকাশ করে।

মামলাটি তদন্তকালে প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী ডিজিস্ট একেএম মনজিল হকের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী শারমিন আক্তার নিশা এবং ঘটনাস্থল বাড়ীর দারোয়ান আবুল কালামও আদালতে জবানবন্দি প্রদান করেছে। উভয় সাক্ষী আসামী একেএম ইয়াসিন হককে সনাক্ত করেছে। 

গ্রেফতারকৃত আসামী রবিউল ইসলাম সিয়াম, মাহফুজুল ইসলাম রাকিব এবং সীমান্ত হাসান তাকবীর-এর ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে ঘটনাস্থল হতে প্রাপ্ত আলামতে থাকা ডিএনএ প্রোফাইলের সাথে পরীক্ষাকালে ম্যাচ করেছে। গ্রেফতারকৃত খুনিদের ফৌঃকাঃবিঃ আইনের ১৬৪ ধারার জবানবন্দি, এজাহারের বক্তব্য এবং সাক্ষী শারমিন আক্তার নিশা ও ঘটনাস্থল বাড়ীর দারোয়ান আবুল কালাম-দের জবানবন্দির মিল রয়েছে।

খুনের পরিকল্পনার সাথে জড়িত আসামী ইয়াসিনের মা লায়লা ইয়াসমিন লিপি, ইয়াসিনের মামা আবু ইউসুফ নয়ন এবং মামলার বাদী ফারুক মিয়া-কে গ্রেফতারের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে বলেও জানিয়েছে সিআইডি।

মন্তব্য ( ০)





  • company_logo