
নিউজ ডেস্কঃ এক সময়ের রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচনি জোট গঠনের সম্ভাবনা সরাসরি নাকচ করে দিয়ে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সঙ্গে আলোচনার দরজা খোলা রয়েছে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ।
সম্প্রতি বার্তা সংস্থা ইউএনবিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জামায়াত ইসলামীকে নিয়ে নির্বাচনি জোটের কোনো সম্ভাবনা আমি দেখছি না। অতীতে কৌশলগত কারণে আমরা জামায়াতের সঙ্গে জোট করেছি, কিন্তু এবার তাদের সঙ্গে জোট গঠনের প্রয়োজন অনুভব করছি না।
বিএনপি এই নেতা জানান, বিএনপি এখন মূলত সেই দলগুলোর সঙ্গে জোট ও জাতীয় সরকার গঠনে মনোযোগী, যারা একযোগে আন্দোলনে এবং গণতান্ত্রিক সংগ্রামে অংশ নিয়েছে। এখন এর বাইরে কিছু ভাবা হচ্ছে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি
এনসিপির সঙ্গে সম্ভাব্য জোট গঠন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত রাজনৈতিক জোট নিয়ে আলোচনা চলবে। কী হয় তা সময়ই বলে দেবে।
তিনি আরও বলেন, সব গণতান্ত্রিক দলই নির্বাচনের আগে নানা কৌশল গ্রহণ করবে। বিএনপি শেষ পর্যন্ত কী কৌশল অবলম্বন করে এবং কার সঙ্গে জোট করে তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নির্বাচন ঘিরে যে দাবিদাওয়া তুলছে, তা তাদের বৃহত্তর কৌশলের অংশ। পাশাপাশি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনেই আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির মধ্যভাগে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
চলমান সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনাকে দ্রুত শেষ করার তাগিদ দিয়ে বিএনপির এই নেতা সতর্ক করে বলেন, অপ্রয়োজনীয় দীর্ঘসূত্রতা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন ঘটাতে পারে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দীর্ঘ আলোচনার প্রতি অসন্তোষ জানিয়ে সালাহউদ্দিন বলেন, আমার মনে হয়, এই আলোচনা অপ্রয়োজনীয়ভাবে দীর্ঘায়িত হচ্ছে। যুক্তিসঙ্গত সময়ের মধ্যেই আলোচনা শেষ হওয়া উচিত ছিল। ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক পরিচালনায় কিছু ঘাটতি রয়েছে, যা পুরো প্রক্রিয়াকে সময়সাপেক্ষ করে তুলছে। আশা করি, এই আলোচনা আর বেশি দিন চলবে না। এখন একটা সারসংক্ষেপ ও সিদ্ধান্তে পৌঁছানো দরকার।
তিনি আরও বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা কার্যত পুনর্প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখন কেবল সুপ্রিম কোর্টের রিভিউ রায়ের অপেক্ষা। আমরা আশা করি, আপিল বিভাগ রিভিউ আবেদনে ইতিবাচক রায় দেবে।
বাংলাদেশের জনগণ নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন চায় জানিয়ে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এই কাঠামোর রূপ কিংবা সাবেক প্রধান বিচারপতিকেই প্রধান উপদেষ্টা রাখার বিষয়টি নিয়ে এখনো বিতর্ক রয়েছে। এই বিষয়ে বিকল্প নিয়ে এখনো আলোচনা চলছে। বিএনপিসহ অন্যান্য দল এবং সংস্কার কমিশন তাদের প্রস্তাব দেবে। যদি আরও ভালো কোনো বিকল্পে একমত না হওয়া যায়, তবে বর্তমান কাঠামোই বহাল থাকবে।
আসন্ন নির্বাচনে অনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) ব্যবস্থা চালুর প্রস্তাবের বিরোধিতা করে এই রাজনীতিক বলেন, বাংলাদেশে এই ব্যবস্থার জন্য উপযোগী রাজনৈতিক, সামাজিক ও নির্বাচন সংস্কৃতি নেই। পিআর ব্যবস্থায় ভোটাররা সরাসরি তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন, ভোটদানে নিরুৎসাহিত হন এবং সংসদে স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমাদের ভোটাররা তাদের পরিচিত ও স্থানীয় প্রার্থীকে ভোট দিতে পছন্দ করেন। কিন্তু পিআর ব্যবস্থায় এমনও হতে পারে যে, একটি এলাকায় কোনো দল বেশি ভোট পেলেও অন্য এলাকার কাউকে নির্বাচিত করা হয়। এটি জনগণের রায়কে প্রতিফলিত করে না, বরং গণতন্ত্রকে দুর্বল করে দেয়। যেসব দেশে পিআর ব্যবস্থা কার্যকর, সেখানে স্থানীয় সরকারগুলোও শক্তিশালী। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়। এখানে সংসদ সদস্যরা সরাসরি উন্নয়ন প্রকল্পে যুক্ত থাকেন। তাই এখানে পিআর কার্যকর হবে না।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে এমন একটি রাজনৈতিক কাঠামো দরকার, যেখানে জনগণ সরাসরি প্রার্থীকে ভোট দিয়ে প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারে। বাংলাদেশ পিআর ব্যবস্থার জন্য প্রস্তুত নয়। এটি কখনো এখানে প্রয়োগ হয়নি; জনগণও এই পদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত নয়।
এই নির্বাচন পদ্ধতির আরেকটি সমস্যা তুলে ধরে সালাহউদ্দিন বলেন, পিআর ব্যবস্থায় স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচনের সুযোগ হারাবেন। কেউ যদি খুব জনপ্রিয়ও হন, কিন্তু কোনো দলে না থাকেন, তাহলে তিনি নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ পাবেন না। এটি অন্যায় এবং অগণতান্ত্রিক।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ছোট দলগুলো পিআর চায়, কারণ এতে তারা কম ভোট পেয়েও বেশি আসন পেতে পারে। কিন্তু এর ফলে দুর্বল জোট সরকার গঠিত হয় এবং দেশে শক্তিশালী নেতৃত্ব গড়ে ওঠে না। পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন কোনো অবস্থাতেই বিএনপি মেনে নেবে না বলেও সাফ জানিয়ে দেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, কিছু দল বিভিন্ন দাবি করছে। কেউ সংস্কার চায়, কেউ বলছে বিচার ছাড়া নির্বাচন নয়, কেউ পিআর চায়। এসব বিভিন্ন উদ্দেশ্যে বলা হচ্ছে। তবে আমরা আত্মবিশ্বাসী, সংবিধান অনুযায়ী আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির মধ্যেই নির্বাচন হবে। কথা বলার অধিকার সবাই রাখে, তবে সেসব বক্তব্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতও হতে পারে।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা নতুন রাজনৈতিক দলগুলোকে সম্মান করি এবং তাদের জন্য শুভকামনা রাখি। কিন্তু প্রকৃত রাজনৈতিক ওজন আসে জনসমর্থন থেকে। ছোট ছোট কিছু দল বড় বড় কথা বললেও তারা খুব অল্পসংখ্যক মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে। রাজনীতিতে জনমতের মূল্য সবচেয়ে বেশি।
বিএনপির জোটসঙ্গী দলগুলোর মধ্যেও মতপার্থক্য দেখা দিতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটি আসলে দর কষাকষির কৌশলেরই অংশ হতে পারে, যেমন ধরুন আসন ভাগাভাগি।
আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিএনপির এই নেতা বলেন, আমার মতে, আওয়ামী লীগ আর কোনো রাজনৈতিক দল নয়। তারা বহু আগেই তাদের আদর্শ ও চরিত্র হারিয়েছে। তারা এখন একটি অগণতান্ত্রিক, ফ্যাসিবাদী শক্তিতে, এক ধরনের মাফিয়া সংগঠনে পরিণত হয়েছে। ১৯৭৫ সালের আগ থেকে আজ পর্যন্ত তাদের ইতিহাসে কখনো গণতন্ত্র চর্চা হয়নি। গণতন্ত্র তাদের রক্তে নেই।
মন্তব্য (০)