• মুক্তমত

অভুক্ত প্রাণীদেরও খাদ্য ব্যবস্থা জরুরী

  • মুক্তমত
  • ০৮ এপ্রিল, ২০২০ ১৭:৪২:৩৪

এস কে দোয়েল:  বেশি দিন হয়নি অস্ট্রেলিয়ার ভয়াবহ দাবানল দেখার। দু’মাসের বেশি সময় ধরে পুড়েছিল অস্ট্রেলিয়ার বনাঞ্চল। সেই দাবানলে অন্তত ১৮জনের মৃত্যু হলেও পুড়ে মারা গেছে ছোট-বড় প্রায় ৫০ কোটি প্রাণী। এই ভয়াবহ দাবানলের চিত্র যখন আমরা স্যাটেলাইট টেলিভিশনে দেখছিলাম, বড় আফসোসের ঝড় উঠেছিল। অনেকের চোখের জলে বুক ভেসে ছিল। ভিডিও চিত্রে জীবন বাঁচানোর ছুটোছুটি দেখে। কারণ, প্রাণীদের প্রতি আমাদের একটি আলাদা একটা ভালোবাসা রয়েছে। মমতা রয়েছে। অনেকেই শখ করে গৃহে নানারকম প্রাণী পালন করে থাকেন। অনেকেই পছন্দ করেন না। আমাদের অনেকের বাড়িতে পোষা প্রাণী হিসেবে কুকুর, বিড়ালসহ বিভিন্ন জাতীয় পশু-পাখি রয়েছে। এসব প্রাণীগুলো আমরা শখের কারণে পালন করি।তারা আমাদের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করে। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে যেকোন সময়, যেকোন কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে সকল প্রাণীর প্রতি দায়বদ্ধতা বেশি বেড়ে যায়। অস্ট্রেলিয়ার দাবানল শুধু বনাঞ্চল পুড়েছে। এতে করেই প্রায় ৫০ কোটি প্রাণী পুড়ে মারা গেছে। আজ করোনা নামের একটি ভাইরাসের থাবায় আতংকিত হয়ে পড়েছে গোটা বিশ্ব। চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া ভয়ংকর ভাইরাস করোনা (কোভিড-১৯)এখন ২০৯ টি দেশকে আক্রান্ত করেছে। প্রাণ কেড়েছে ৮২ হাজারেরও বেশি মানুষ। আক্রান্ত করেছে ১৪ লাখ ৩১ হাজার ছাড়িয়েছে। বেড়েই চলেছে আক্রান্ত-মৃত্যুর সংখ্যা। অস্ত্রবিহীন যুদ্ধ হলেও জৈবিক জীবাণুর ভয়ংকর শত্রু এই করোনা ভাইরাস। ক্রমাগত বাড়ছে বাড়ছে মৃত্যু-আক্রান্তের সংখ্যা। এই ভয়াবহ অবস্থা উত্তোরণের জন্য গোটা বিশ্ব জুড়ে চলছে নিরন্তর টিকে থাকার যুদ্ধ। আমাদের বাংলাদেশে ভাইরাসটিতে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭ জনে এবং আক্রান্তের সংখ্যা ১৬৪ জন। বলা হচ্ছে এর ভয়াবহতা বাড়তে পারে। ভাইরাসটি যেহেতু সংক্রামক, তাই এই সংক্রামক থেকে দূরে রাখতে মানুষদের ঘরে রাখতে লকডাউন, শার্টডাউন ব্যবস্থা চলছে। মানুষ যাতে এ ভাইরাসের সংক্রমণের মাধ্যমে নিজে সংক্রমিত না হয়, আক্রান্ত হলেও অন্যকে আক্রান্ত করতে না পারে, এজন্য হোম কোয়ারেন্টাইন, সেল্ফ কোয়ারেন্টাইন আর আইসোলেশনে রেখে ভাইরাসটি প্রতিরোধের প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। ঘরবন্ধী মানুষদের জন্য সরকা খাদ্য পৌছানোর ব্যবস্থা করছেন। জনজমায়েত হয় এধরণের সকল ধরণের উৎসব, কর্মস্থল, দোকানপাট, হোটেল-রেস্টুরেন্ট, বিনোদন কেন্দ্র, পর্যটন কেন্দ্র, গণপরিবহন, সাধারণ যানবাহন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এটার কারণের নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের দূর্ভোগ তৈরি হলেও “ঘর ফেরা খাদ্য কর্মসূচি” নিয়েছেন সরকার। এজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। এ প্যাকেজ প্রণোদনা সঠিকভাবে বিতরণ করা হলেও ঘরমুখী মানুষ উপকৃত হবেন। এছাড়া স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি উদ্যোগেও নিম্ন আয়ের মানুষদের মাঝে খাদ্য সহায়তা চোখে পড়ছে। অনেকে মধ্যবিত্ত ভোগী অসহায় মানুষদেরও বাড়িতে খাবার পৌছে দিচ্ছেন, তবে তা অপ্রতুল। তা বাড়াতে হবে, বেশি জোর দিতে হবে। কারণ মধ্যবিত্তরাই বেশি অসহায়, কারণ তারা না পারেন সাহায্য চাইতে, না পারেন দূর্ভোগ সইতে। এতো গেল, মানুষদের সুরক্ষা রাখার ব্যবস্থা। মানুষের পাশে মানুষের দায়বদ্ধতা। মানুষকে সুরক্ষায় রাখতে লকডাউন, শাটডাউন ও ঘরে থাকার জন্য তো সরকার বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করলেন। কিন্তু চলমান লকডাউনের কারণে সমস্ত দোকানপাট বন্ধ করে দেয়ার কারণে শহরের বিভিন্ন রাস্তা-ঘাট, গ্রামগঞ্জের পাড়া-মহল্লার ডাস্টবিনগুলোতে তেমন উচ্ছিষ্ট খাবার পড়ে থাকছে না। আর রাস্তা-ঘাট জনশূন্য হয়ে পড়ায় খাদ্য সংকটে পড়া কুকুর, বিড়াল, বানরের মতো প্রাণীগুলো আশপাশে ছুটাছুটি করেও পাচ্ছে না খাবার। অভুক্ত অবস্থায় রাস্তার পাশে কিংবা কোনো বন্ধ দোকানের সামনে কিছু খাবারের প্রত্যাশায় চেয়ে থাকে। সংকটময় এই মুহূর্তে অভুক্ত প্রাণীগুলোকে নিজের খাবারের কিছু উচ্ছিষ্ট দেয়া দরকার। এসব অভুক্ত প্রাণীগুলোকে অন্তত সারাদিনে এক-দুবার কিছু খাবার পেলেও বেঁচে থাকবে তারা। তাই মানুষের খাদ্য নিশ্চয়তার পাশাপাশি প্রাণীকুলের খাদ্য নিশ্চয়তা করা সরকারের দায়িত্ব। পাশাপাশি মানুষ হিসেবে প্রাণীদের প্রতি রয়েছে দায়িত্ব-কর্তব্য। শুধু সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়; এটার সম্মেলিত নিতে হবে সবাইকে। আমরা যা খাই না, তা থেকেও প্রাণীদের মুখে তুলে দিতে পারি খাবার। এজন্য সরকার দেশের সকল প্রশাসন, স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে খাদ্য সংকটে থাকা অভুক্ত প্রাণীদের কাছে খাবার দ্রুত পৌছানো প্রয়োজন। খাদ্য সংকটে পড়া বিভিন্ন এলাকায় অভুক্ত প্রাণীদের পাশে ব্যক্তি ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কিছু উদ্যোগ দেখে। সোস্যাল মিডিয়া ফেসবুকে শেয়ার করা এ উদ্যোগগুলো অনুপ্রেরণা তৈরি করেছে। রাজধানী শহরের বিভিন্ন পথে ঘুরে বেড়ানো বেশ কিছু কুকুরের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করেছিলেন দুই বাংলার জনপ্রিয় অভিনেত্রী জয়া আহসান। তিনি ২৭ মার্চ থেকে টানা কয়েকদিন নিজ হাতে ভাত ও মুরগির তরকারি রান্না করে রাস্তায় নেমে ঢাকার দিলুরোড, ইস্কাটন গার্ডেন ও মগবাজার এলাকায় ঘুরে বেড়ানো ২৫-৩০টি কুকুরের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করেন এ অভিনেত্রী। পিরোজপুরের জেলা প্রশাসক আবু আলী মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পিরোজপুর ইউথ সোসাইটির তরুণদের নিয়ে পৌর এলাকার বিভিন্ন সড়কে ঘুরে ঘুরে ক্ষুধার্ত কুকুরদের নিজ হাতেই খাবার দিয়েছেন। রাতে ক্ষুধার্ত কুকুরদের খাবার পৌছে দিয়েছেন। গত ৫ এপ্রিল দেখা গেছে, ইয়ংস্টার কমিউনিটি বাংলাদেশ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রাজধানীসহ বেশ কিছু এলাকায় খাদ্য সংকটে পড়া অভুক্ত কুকুর, বিড়ালকে রান্না করা খাবার সরবরাহ করার খবরসংবাদমাধ্যমে এসেছে। রাজশাহী সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে কুকুর, বিড়ালসহ অভুক্ত প্রাণীগুলোকে খাবার খাওয়ানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। সোমবার (৬ এপ্রিল) ক্ষুধার্ত কুকুরদের পাউরুটি, বিস্কুট ও কেক খাইয়েছেন রাসিক মেয়র খায়রুজ্জামান লিটন। প্রতিদিন মহানগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ঘুরে প্রাণীগুলোকে খাবার খাওয়ানোর নিদের্শ দেয়ার বিষয়টি খুব ভালো লেগেছে। এরকম একটি উদ্যোগ নিয়েছেন পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান কাজী মাহমুদুর রহমান ডাবলু। তিনি স্থানীয় ইয়াংস্টার কমিউনিটির মাধ্যমে প্রণোদনার সহযোগিতার মাধ্যমে তেঁতুলিয়া উপজেলার অভুক্ত কুকুর-বিড়ালদের খাদ্য সরবরাহ বিষয়টিও অনুপ্রেরণা তৈরি করেছে। এরকম দেশের প্রতিটি স্থানে করোনা ভাইরাসের প্রকোপের কঠিন এ মুহুর্তে চারপাশে খাদ্য সংকটে থাকা অভুক্ত প্রাণীদের খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারলে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সবার ঐকান্তিক সহযোগিতা চালিয়ে যাবেন এমনটি আশাব্যক্ত করছি। এদিকে দিনাজপুরের বীরগঞ্জে জাতীয় উদ্যান সিংড়া ফরেস্টের শকুন উদ্ধার ও পরিচর্যা কেন্দ্রে প্রায় ছয় মাস থাকার পর মুক্ত হয়েছে বিরল প্রজাতির ১২টি শকুন। গত বছর ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, নীলফামারী, গাইবান্ধাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে ১২টি শকুন উদ্ধার করে এখানে রাখা হয়। পরিযায়ী এই পাখিগুলো খাদ্য অনিশ্চয়তায় ভুগছে। পরিচর্যা কেন্দ্রের কর্মী বেলাল হোসেন জানিয়েছেন, গত ৫ এপ্রিল রবিবার খাদ্যের জন্য শকুনগুলোকে মুক্ত করা হলেও তাকে ছেড়ে যাচ্ছে না অভুক্ত পাখিগুলো। দিনমজুর হয়ে এ পাখিদের খাবারের জোগান দেওয়া তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বিলুপ্ত প্রায় এ অভুক্ত পাখিগুলোর খাদ্য সরবরাহ জরুরী। সর্বোপরী কঠিন এ পরিস্থিতিতে মানুষদের পাশাপাশি অভুক্ত প্রাণীদের মুখে তুলে দিয়ে ঐক্যত্ব মানবিকতার পরিচয় দেই। অস্ট্রেলিয়ার সেই দাবানলের ধ্বংসস্তূপের পর যেখানে গজে উঠেছিল সবুজ চারা, সে চারার বিশুদ্ধ বাতাস ছড়িয়ে দিতে সংকট মোকাবেলায় লড়াই করে নিজেদের টিকিয়ে রাখার পাশাপাশি প্রাণীকুলকেও বাঁচিয়ে রাখি নিজেদের দায়বদ্ধতায়।   এস কে দোয়েল সাংবাদিক ও কলামিস্ট তেঁতুলিয়া, পঞ্চগড়।

মন্তব্য ( ০)





  • company_logo