• মুক্তমত

আগস্ট: শোককে শক্তিতে পরিণত করার মাস

  • মুক্তমত
  • ০৮ আগস্ট, ২০১৯ ১৪:২০:৫২

ড. মোহাম্মদ আলমগীর কবীর: ১৯৪৯ সনের ২৩ জুন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দলটি এদেশের মানুষের অধিকার আদায়ে কাজ করছে। দলটির নেতৃত্বে ১৯৫২ এ ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ এ যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়লাভ, ১৯৫৫ এ ধর্মনিরপেক্ষতা চর্চা, ১৯৬৬ এ ছয় দফা দাবী, ১৯৬৯ এ গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ এ নির্বাচনে জয়লাভ এবং ১৯৭১ সনে স্বাধীনতা আন্দোলন ছিল উল্লেখযোগ্য। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে যে মানুষটি জীবন বাজি রেখে সামনে থেকে দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি হলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর দেশপ্রেম, নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের পাশে থাকা, গরিব ও মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের কাজকে দেশি-বিদেশি একটি চক্র কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি। ১৯৭১ এ স্বাধীনতার পরবর্তী বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সরকার গঠনের পর থেকেই ওই কুচক্রী মহল সক্রিয় হয়ে উঠে এবং বঙ্গবন্ধুর সরকারকে নানাভাবে বেকায়দায় ফেলা ও উৎখাতের চেষ্টা করে। অবশেষে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে ষড়যন্ত্রকারীরা (কিছু বিপথগামী সেনা অফিসার) বঙ্গবন্ধুর বাসভবন আক্রমণ করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ও ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থানরত আনন্দবাজার পত্রিকার সংবাদদাতা সুখরঞ্জন দাসগুপ্ত তাঁর ‘মিডনাইট ম্যাসাকার ইন ঢাকা’ বইয়ে লিখেন, মুজিব হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত বর্ণনা সবসময় রহস্যে ঘনীভূত থাকবে। তিনি আরও লিখেন, মুজিবের বাসভবন রক্ষায় নিয়োজিত আর্মি প্লাটুন প্রতিরোধের কোনো চেষ্টা করেনি। মুজিবের পুত্র, শেখ কামালকে নিচতলার অভ্যর্থনা এলাকায় গুলি করে হত্যা করা হয়। মুজিবকে পদত্যাগ করা ও তাঁকে এ বিষয়ে বিবেচনা করার জন্য বলা হয়। মুজিব সামরিক বাহিনীর প্রধান, কর্নেল জামিলকে টেলিফোন করে সাহায্য চান। জামিল ঘটনাস্থলে পৌঁছে সৈন্যদের সেনানিবাসে ফিরে যাওয়ার জন্য আদেশ দিলে তাঁকে সেখানে গুলি করে মারা হয়। শেখ মুজিবকেও গুলি করে হত্যা করা হয়। ১৫ আগস্ট ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম এ হত্যাকাণ্ডের আরও শিকার হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ভাই শেখ আবু নাসের, ছেলে শেখ জামাল, শিশুপুত্র শেখ রাসেল, পুত্রবধূ দেশবরেণ্য সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মণি ও তার অন্তঃসত্বা স্ত্রী বেগম আরজু মণি, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি ও তার মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য কৃষক নেতা আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছোট মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত, কনিষ্ঠ শিশুপুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত আবদুলাহ বাবু, ভাইয়ের ছেলে শহীদ সেরনিয়াবাত, আবদুল নঈম খান রিন্টু। এ ছাড়াও আওয়ামী লীগের চারজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য (জাতীয় চারনেতা) তাজউদ্দীন আহমেদ, এম মনসুর আলী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং আ হ ম কামরুজ্জামানকে আটক করা হয়। তিন মাস পরে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বরে তাঁদের সকলকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয়। বিদেশে থাকায় ঐদিন প্রাণে বেঁচে যান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা। দীর্ঘ প্রায় ৬ বছর পর ১৯৮১ সনের ১৭ মে দেশে ফেরেন বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। দেশে ফিরেই তিনি দলকে সংগঠিত করেন এবং সর্বসম্মতিতে দলের সভানেত্রীর দায়িত্ব গ্রহন করেন। তাঁর দক্ষ নেতৃত্বে নানা প্রতিকূল পরিবেশ ও ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে ১৯৯৬ সনে দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ যখন সুসংগঠিত ঠিক আবারও শুরু হয় তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও জীবন নাশের হুমকি। অধিকন্তু পিতার মতো বরাবরই তিনিও ছিলেন ঘাতকের ষড়যন্ত্রের টার্গেট। একবার নয়, দুইবার নয়, শেখ হাসিনাকে ১৯ বার হত্যার চেষ্টা চালানো হয়েছিল। তাঁকে এবং আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার জন্য ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকায় আওয়ামী লীগের এক জনসভায় গ্রেনেড হামলা করা হয়। ওই হামলায় ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত হন এবং তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাসহ প্রায় ৩০০ লোক আহত হয়। সে হামলায় নিহতের মধ্যে মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী আইভি রহমান অন্যতম, যিনি ছিলেন বাংলাদেশের ১৯তম রাষ্ট্রপতি প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা জিল্লুর রহমানের স্ত্রী। বাংলাদেশর ইতিহাসে এখন পর্যন্ত নৃশংস সহিংসতার যেসব ঘটনা ঘটেছে, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনা তার একটি। আগস্ট মাস আওয়ামী পরিবারের জন্য একটি শোক ও বেদনার মাস। ঘাতকচক্র ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারকে হত্যা করেই থেমে থাকেনি, তারা আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে চেয়েছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকেও ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করেছে, দেশের অগণিত আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীকে বিনা অপরাধে হত্যা ও নির্যাতন করেছে, বিনা কারণে হামলা-মামলা দিয়েছে, বাড়িঘর লুন্টন ও জ্বালিয়ে দিয়েছে। এত হামলা-মামলা, হত্যা, নির্যাতন, নিপীড়ন সর্বোপরি শোক ও বেদনাকে শক্তিতে পরিণত করে ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী পরিবারের নেতাকর্মীরা ঘুরে দাঁড়িয়েছে, আশ্রয় ফিরে পেয়েছে এবং ১৯৯৬ সনে সকল প্রতিকূল পরিবেশকে জয় করে এদেশের মানুষের সেবা করার সুযোগ পেয়েছে। থেমে নেই আওয়ামী ও স্বাধীনতা বিরোধীচক্র, ২০০১ সনে আবারও দেশি-বিদেশি নানা চক্রান্তে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচূত করা হয় এবং নেমে আসে দলীয় নেতা-কর্মীদের উপর আমানুষিক নির্যাতন, নিপীড়ন, হামলা-মামলা, গুম, হত্যা, যার সর্বশেষ পরিণতি ২০০৪ সনের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা। এই হামলার উদ্দেশ্য খুবই স্পষ্ট, শেখ হাসিনাকে হত্যা এবং আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করা। আল্লার অশেষ বেহেরবানিতে শেখ হাসিনা সেদিন প্রাণে বেঁচে যান। ২৪ জন দলীয় নেতাকর্মীর জীবন ও প্রায় ৩০০ নেতাকর্মীর আহত হওয়ার মধ্যে দিয়ে এবং নিজেও বেঁচে আছেন আহত ও সেদিনের বীভৎস স্মৃতি নিয়ে। সেই ২০০৪ সনের ২১ আগস্টের ভয়াবহ স্মৃতি, দলীয় নেতাকর্মীদের উপর অমানষিক নির্যাতন, নিপীড়ন, গুম, হত্যা, হামলা-মামলা, শোক ও বেদনাকে শক্তিতের পরিণত করে ২০০৮ সনে আবারও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী পরিবারের নেতাকর্মীরা ঘুরে দাঁড়িয়েছে, বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে এসেছে এবং সকল প্রতিকূল পরিবেশকে জয় করে এদেশের মানুষের সেবা করার সুযোগ পেয়েছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মাস ও দিবস আছে যা ভিন্ন ভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠী বিভিন্নভাবে উদযাপন করে থাকে। এছাড়া বাঙ্গালি জাতির গুরুত্বপূর্ণ মাস ও দিনসমূহ ফেব্রুয়ারি (২১), মার্চ (৭, ২৫, ২৬), জুন (১২, ২৩), আগস্ট (১৫, ২১), ডিসেম্বর (১৪, ১৬) বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আগস্ট শোক ও শক্তির মাস। এ মাসে বাঙ্গালি জাতি শোককে শক্তিতে পরিণত করেছে এবং বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। তাই শোক ও শক্তির মাস আগস্ট। লেখক: অধ্যাপক ও সাবেক প্রভোস্ট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য ( ০)





  • company_logo