• সমগ্র বাংলা

ডিসি অফিসের সাবেক পিয়ন চার হাজার কোটি টাকার মালিক!

  • সমগ্র বাংলা
  • ২৫ জানুয়ারী, ২০১৯ ০০:০৭:৩৮

আবদুল মান্নান তালুকদার (৬০) ছিলেন বাগেরহাট ডিসি অফিসের (জেলা প্রশাসকের কার্যালয়) নেজারত শাখার উমেদার (এমএলএসএস)। ২৬ বছর চাকরি করে তিনি স্বেচ্ছায় অবসর নেন ২০১০ সালে। চতুর্থ শ্রেণির এই কর্মচারী মাসে বেতন পেতেন সাকল্যে পাঁচ হাজার টাকা। নিজেকে ‘সৎ ও ধার্মিক’ দাবি করা ‘চরমোনাই পীরের’ অনুসারী মান্নান এখন দুই-চার হাজার কোটি টাকার মালিক। হেলিকপ্টারে চড়ে বিভিন্ন এলাকায় যেতেন তিনি। ৪০০ একর জমি, আটটি বিলাসবহুল গাড়ি ছাড়াও খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুরসহ বিভিন্ন শহরে মার্কেট, জুটমিলসহ তার রয়েছে অঢেল সম্পত্তি। বাগেরহাট শহরে তার বাড়িটি শতাধিক সিসি ক্যামেরায় ঘেরা। সমিতি ও রিয়েল এস্টেটের মাধ্যমে তিনি দুই থেকে চার হাজার কোটি আত্মসাৎ করেছেন এ অভিযোগ পেয়ে অনুসন্ধানে নামছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তবে গত মাসেই ‘গায়েব’ হয়ে গেছেন উমেদার মান্নান। সপরিবারে তিনি দেশ ছেড়েছেন বলেও শোনা যাচ্ছে। দুদকের একাধিক কর্মকর্তা জানান, খুলনা ও বাগেরহাট অঞ্চলে অবৈধ ব্যাংকিং ও মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে হাজার কোটি টাকার মালিক হওয়া মান্নান তালুকদারের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের জন্য প্রধান কার্যালয়ে নথি পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন পেলে এ বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু হবে। এ বিষয়ে দুদকের খুলনা সমন্বিত বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক নাসিম আনোয়ার বলেন, ‘ফাইলপত্র দেখে অগ্রগতির বিষয়ে জানাতে হবে।’ বাগেরহাটের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুই হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থ আত্মসাৎ করে ‘গায়েব’ হয়ে গেছেন উমেদার থেকে জমিদার বনে যাওয়া মান্নান। তিনি দেশে না বিদেশে আছেন, জানাতে পারছে না পুলিশ, দুদক বা অন্য কোনো সংস্থাই। স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের কাছেও তার অবস্থানের বিষয়ে পরিষ্কার কোনো তথ্য নেই। গত ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০ ডিসেম্বর সপরিবারে এলাকা ছাড়েন আবদুল মান্নান। গতকাল শনিবার বাড়িতে গিয়েও তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তবে এই কদিন বাড়িতে থাকা তার কার্যালয়টি বন্ধ থাকলেও গতকাল শনিবার তা খোলা ছিল। তবে কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অধিকাংশই গা-ঢাকা দিয়েছেন। দুদকে প্রাপ্ত অভিযোগ থেকে জানা যায়, চরমোনাই পীরের মুরিদ উমেদার আবদুল মান্নান। তিনি বাগেরহাট ও খুলনা অঞ্চলে চরমোনাইয়ের অনুসারীদের বড় অর্থদাতা। ‘নিউ বসুন্ধরা সঞ্চয় ও ঋণদান সমিতি’র মাধ্যমে খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, পিরোজপুর জুড়ে তার অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ‘জাল ছড়ানো’। তার সমিতি ‘শরিয়া মোতাবেক’ পরিচালিত উল্লেখ করে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ‘আমানত’ সংগ্রহ করেন মান্নান। আর কৌশলে এলাকার মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন, বেকার যুবক ও চরমোনাই পীরের মুরিদদের কাজে লাগান তিনি। এক লাখ টাকা সঞ্চয় রাখলে প্রতি মাসে দুই হাজার টাকা লাভ ও চার বছরে দ্বিগুণ-এমন অধিক মুনাফা দেখিয়ে আমানত (সঞ্চয়) সংগ্রহ করেন মান্নান। আবার ঋণ দেন চড়া সুদে। ‘নিউ বসুন্ধরা রিয়েল এস্টেট সঞ্চয় ও ঋণদান সমিতি’র মাধ্যমে ৪০ হাজারেরও বেশি গ্রাহকের কাছ থেকে দুই হাজার কোটি টাকারও বেশি আমানত সংগ্রহ করে আত্মসাৎ করেছেন তিনি। খুলনার চিকিৎসক আবদুর রাজ্জাক ১৫ লাখ টাকা জমা রেখেছেন ওই সমিতিতে। তিনি বলেন, “আমি হজ করার সময় মোয়াল্লেম ছিলেন হাজি হায়দার আলী। তিনি আমাকে বলেন, ‘আমরা সমিতিতে সঞ্চয় রেখেছি। আপনিও রাখেন।’ সরল বিশ্বাসে আমি ১৫ লাখ টাকা সঞ্চয় রেখেছি চার বছর আগে। দ্বিগুণ লাভ দূরে থাক, প্রকৃত অর্থই ফেরত পাচ্ছি না। চাইতে গেলে নানা কথা শোনায়।” ‘নিউ বসুন্ধরা রিয়েল এস্টেট’র কথিত শরিয়াহ বোর্ডে ছিলেন খুলনার গোয়ালখালী মাদ্রাসার মুহতামিম খলিফা আবদুল আউয়াল ও মুফতি ওয়াক্কাস আলীসহ চরমোনাই পীরপন্থি আলেমরা। বোর্ডের চেয়ারম্যান মুফতি ওয়াক্কাস জানান, কাকে, কী পরিমাণ লাভ দেওয়া হবে, কিছুই তিনি জানতেন না। কোম্পানির লাভ-ক্ষতি, আয়-ব্যয় সবই চেয়ারম্যান (মান্নান) জানেন। দুদকে দেওয়া অভিযোগে বলা হয়, বাগেরহাট শহরের মিঠাপুকুর এলাকার কে আলী রোডের মৃত হেমায়েত উদ্দিন তালুকদার ও সালেহা বেগমের ছেলে আবদুল মান্নান। মাদ্রাসায় পড়াশোনা করলেও তার কোনো সার্টিফিকেট নেই। ১৯৮৪ সালে বাগেরহাট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এমএলএসএস বা উমেদার পদে নিয়োগ পান এবং ২০১০ সালে স্বেচ্ছায় অবসর নেন তিনি। মিঠাপুকুরে প্রি-ক্যাডেট মাদ্রাসার লাগোয়া তিনতলা ভবন তার কার্যালয় ও বাড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই বাড়িটিকে কার্যালয় হিসেবে দেখিয়ে ‘হলমার্ক গ্রুপের’ মতো নাম ও প্যাডসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান গড়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। মান্নান তালুকদারের ভিজিটিং কার্ডে লেখা হয়েছে, ‘ম্যানেজিং ডাইরেক্টর, সাবিল গ্রুপ’ যার করপোরেট অফিস ঢাকার দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকায় বিসিআইসি ভবনের ১৬ তলায়। রেজিস্ট্রি অফিস খুলনার বয়রাবাজারে আর প্রধান কার্যালয় বাগেরহাটের মিঠাপুকুরে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের শাখা রয়েছে সাতক্ষীরা, নড়াইল, পিরোজপুর ও যশোরে। তার ভিজিটিং কার্ডে আরও যেসব প্রতিষ্ঠানের নাম রয়েছে সেগুলো হচ্ছে-অ্যাজাক্স জুট মিলস, সাবিল পেপার মিলস, সাবিল লেদার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, সাবিল অটোমেটিক ব্রিক লিমিটেড, বাগেরহাট ট্রেডিং লিমিটেড, জাকারিয়া এন্টারপ্রাইজ ও নিউ বসুন্ধরা রিয়েল এস্টেট লিমিটেড। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অ্যাজাক্স জুট মিল এখনো চালু হয়নি। এটা কেনার সময় তিনি যে চেক দিয়েছেন তা ব্যাংক থেকে ফেরত এসেছে। সাবিল পেপার মিল ও লেদার ইন্ডাস্ট্রিজ নামসর্বস্ব বা প্রস্তাবিত। সাবিল অটোমেটিক ব্রিক লিমিটেডের প্রস্তুতি চলছে। নিউ বসুন্ধরা রিয়েল এস্টেটের অফিস রয়েছে। প্রকল্পের জন্য জমি আছে, কিন্তু কোনো ভবন নেই। প্রস্তাবিত সাবিল টুইন টাওয়ার, সাবিল ড্রেজিং অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড, প্রস্তাবিত তিনতলা মার্কেট, সাবিল জেনারেল হাসপাতাল, সাবিল বৃদ্ধাশ্রম, সাবিল কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প, সাবিল ডিজিটাল প্রিন্টার্স প্রকল্প এ সবই নাম ও সাইন বোর্ডসর্বস্ব। উমেদার মান্নানের প্রতারণার বিষয়ে জানতে চাইলে বাগেরহাট জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান টুকু বলেন, ‘উমেদার মান্নান শুরু থেকেই প্রতারক ছিলেন।আমি তাকে কোনো ধরনের সহযোগিতা কখনো করিনি। এখন শুনছি সে আত্মগোপন করেছে। কিসের ভিত্তিতে কীভাবে সে হাজার হাজার কোটি টাকা কথিত আমানত সংগ্রহ করেছে, হাজার হাজার মানুষ কেন তাকে টাকা দিয়েছে আমার কাছে বিষয়টি পরিষ্কার নয়। আমি দুদকসহ প্রশাসনকে বলেছি বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার। যারা টাকা জমা রেখেছে তাদের টাকা ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তা দরকার।’ বাগেরহাট সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, ‘গত ৮-১০ বছর থেকে যারা উমেদার মান্নানের সমিতিতে টাকা জমা দিয়েছেন তারা কেউ আমানত ফেরত পেয়েছেন, এমন কোনো প্রমাণ নেই। তিনি কয়েক হাজার টাকা দুবাইতে পাচার করেছেন। এখন সাধারণ মানুষের টাকা না দেওয়ার জন্য তিনি আত্মগোপন করেছেন। ’বাগেরহাট জেলা পুলিশ সুপার পঙ্কজ চন্দ্র রায় বলেন, ‘নিউ বসুন্ধরা রিয়েল এস্টেটের মালিক আবদুল মান্নান তালুকদার ডিসি অফিসের উমেদার ছিলেন বলে আমি শুনেছি। তিনি আত্মগোপন করেছেন কি না বা কোথায় আছেন সেটা আমার জানা নেই। তবে তার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায় সেটা আমরা দেখছি।’ এর আগে মান্নান তালুকদার স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেছিলেন, তিনি জীবনে কখনো ঘুষ খাননি, এর সঙ্গে জড়িতও নন। কালেক্টরেট ভবনে চাকরির সুবাদে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। শুধু চাকরির বেতনে সংসার চলবে না ও সৎ থাকা যাবে না- এ ভাবনা থেকে চাকরি জীবনের শুরুতেই পরিকল্পনা মোতাবেক তিনি জমি কেনা শুরু করেন। তার আয়ত্তের মধ্যে শুরু করেন জমির ব্যবসা। তিনি যে জমিতে হাত দিয়েছেন সেখানেই সোনা ফলেছে। তিনি যখন জমির ব্যবসা শুরু করেন তখন পদ্মার পশ্চিম পাড়ে কোনো রিয়েল এস্টেট ছিল না। তার ভাষ্য, তার বর্তমান সম্পদ দুই হাজার কোটি টাকারও বেশি। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর পেনশনের টাকা তিনি দান করে দিয়েছেন। দায়িত্ব পালনে কোনো ত্রুটি থাকলে তিনি মরার পরে কী জবাব দেবেন? আত্মগোপনে থাকায় এখন তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। তার মোবাইল ফোনে এসএমএস পাঠানো হলেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

মন্তব্য ( ০)





  • company_logo