• সমগ্র বাংলা

গাজীপুরে ট্রেন দুর্ঘটনা: সংশ্লিষ্টদের দাবী নাশকতা, ঘটনা তদন্তে তিন কমিটি

  • সমগ্র বাংলা
  • ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৩ ২০:৫১:৩৩

ছবিঃ সিএনআই

 শ্রীপুর,গাজীপুর প্রতিনিধি: গাজীপুরে অবরোধকারীরা নাশকতার জন্য ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথের রেললাইন কেটে ফেলায় ঢাকাগামী যাত্রীবাহী মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ট্রেনের ইঞ্জিনসহ ৭টি বগি রেললাইন থেকে ছিটকে নীচে পড়ে এবং রেললাইন দুমড়ে মুচড়ে যায়। এ ঘটনায় এক মুরগি ব্যবসায়ী নিহত এবং চালক ও তার সহকারীসহ অন্ততঃ ১০ জন আহত হয়েছেন। বুধবার (১৩ ডিসেম্বর) ভোর সাড়ে ৪টার দিকে জেলার শ্রীপুর উপজেলার বনখড়িয়া (চিলাই ব্রিজ) এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। ঘটনা তদন্তের জন্য তিনটি পৃথক তদন্ত কমিটি গঠণ করা হয়েছে। নিহত আসলাম (৩৫) ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলা রৌহা গ্রামের মোসলেম উদ্দিনের ছেলে। তিনি মুরগী ব্যবসায়ী।

গাজীপুর ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক (ডিএডি) আব্দুল্লাহ-আল আরেফিন জানান, মঙ্গলবার দিবাগত রাতের কোন এক সময় দুষ্কৃতিকারীরা গ্যাস কাটার দিয়ে গাজীপুরের ভাওয়াল স্টেশন ও রাজেন্দ্রপুর স্টেশনের মধ্যবর্তী বনখড়িয়া এলাকার চিলাই নদীর উপর নির্মিত চিলাই ব্রীজের প্রায় একশ’ ফুট উত্তর পাশে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথের পূর্ব পাশের প্রায় ২০ ফুট রেললাইন কেটে রাখে। এলাকাটি দুর্গম ও নির্জন। রাত ১১ টায় মোহনগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটি বুধবার ভোর সাড়ে ৪টার দিকে ব্রীজে উঠার আগে সেখানে আসা মাত্রই বিকট শব্দে ইঞ্জিনসহ পরবর্তী ৭টি বগি লাইনচ্যুত হয়ে ছিটকে রেললাইনের ঢালে কাত পড়ে। তবে ইঞ্জিনটি বগি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে লাইনের পাশের জমিতে কাত হয়ে পড়ে। এঘটনায় এক ব্যবসায়ী নিহত এবং চালক (লোকোমাস্টার) ও তার সহকারী চালক এবং নারীসহ অন্ততঃ ১০ জন যাত্রী আহত হয়েছেন। বিকট শব্দ শুনে আশেপাশের লোকজন ঘটনাস্থলে এসে ভীড় জমায়। খবর পেয়ে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে স্থানীয়দের সহায়তায় হতাহতদের উদ্ধার করে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন ক্লিনিকে পাঠানো হয়। এঘটনায় রেললাইনের অন্ততঃ ৬০০ ফুট দুমড়ে মুচড়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা রেল লাইনের পাশ থেকে একটি ও ঘটনাস্থলের পাশের জঙ্গল থেকে আরো একটি গ্যাসের সিলিন্ডার (বোতল) উদ্ধার করেছে। প্রতিটি সিলিন্ডার ১২ কেজি ওজনের।

তিনি জানান, ঘন কুয়াশার কারনে ঘটনার সময় ট্রেনের গতি স্বাভাবিকের চেয়ে কম ছিল। এ ঘটনায় ৭টি বগি লাইনচ্যুত হয়ে একজন নিহত ও ১২/১৩ জন আহত হলেও ট্রেনটি বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেয়েছে। গতি বেশী থাকলে হতাহতের সংখ্যা ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো বেশী হওয়ার সম্ভাবনা ছিল।

এদিকে সকাল ৯টার দিকে ঢাকা থেকে উদ্ধারকারী ট্রেন ঘটনাস্থলে পৌছে উদ্ধার কাজ শুরু করে। এসময় শ্রীপুর থেকে একটি ইঞ্জিন এনে দূর্ঘটনা কবলিত বগিগুলো বাদে অবশিষ্ট বগিগুলো টেনে শ্রীপুর স্টেশনে নিয়ে যায়। দূর্ঘটনা কবলিত বগিগুলো উদ্ধার শেষে বিকেলে রেললাইন মেরামতের কাজ করে।

রেল কর্মকর্তা মোশারেফ হোসেন ভুইয়া বলেন, দুর্ঘটনার পর থেকেই ঢাকা-ময়মনসিংহ রেল পথে ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ পথে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় ঢাকা থেকে ময়মনসিংহগামী ট্রেনগুলো ভৈরব-কিশোরগঞ্জ হয়ে চলছে। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত বলাকা কমিউটার, দেওয়ানগঞ্জ কমিউটার ও মহুয়া কমিউটার ট্রেনের যাত্রা কর্তৃপক্ষের আবেদনে বাতিল করা হয়েছে। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ঢাকা বিভাগীয় রেলওয়ে মহাব্যবস্থাপক মো. কামরুল আহসান, গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম ও গাজীপুরের পুলিশ সুপার কাজী  সফিকুল আলম ঘটনাস্থল পরিদর্শণে আসেন।

আহত ১২ জন গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. রফিকুল ইসলাম জানান, ট্রেন দূর্ঘটনায় আহত ১২ জনকে এ হাসপাতালে আনা হয়েছে। তারা হলেন ট্রেন চালক মো. ইমদাদুল হক (৫৭) ও সহকারী চালক মো. সবুজ মিয়া (৩২), ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার রফিকুল মোল্লা (৩৫), একই উপজেলার জামিলা (৩৫), কুমিল্লার জসিম উদ্দিনের মেয়ে সুরভী সাহা (১৮), গৌতম সাহার স্ত্রী রুপালি সাহা (৪০), মনির উদ্দিনের ছেলে বেলাল উদ্দিন ( ৪০),  জসিম উদ্দিনের স্ত্রী রওশন আরা (৪২), নিজাম উদ্দিনের ছেলে জলিল (৩৮), লালু মিয়ার ছেলে সুমন (২৫), কুদ্দুসের ছেলে সবুজ (৩২), ইসমাইল হোসেনের ছেলে এমদাদ (২৫), নেত্রকোনার গনু  মিয়ার ছেলে রফিকুল ইসলাম মোল্লা (৪০)। এদেরমধ্যে গুরুতর আহত ট্রেন চালক ইমদাদুল হক, সহকারী চালক মো. সবুজ মিয়া ও রুপালি সাহা ঢামেক হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। অপর আহত রফিকুল ইসলাম মোল্লা, জামিলা ও সুরভী সাহাকে এ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অন্যরা প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে এখান থেকে চলে গেছেন।

ঘটনাস্থল পরিদর্শনে ঢাকা বিভাগীয় রেলওয়ে মহাব্যবস্থাপক, ডিসি ও এসপি গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, শীতের রাত ও কুয়াশা থাকায় ট্রেনের গতি কম ছিল। তাই হতাহতের সংখ্যা কম হয়েছে। একজন যাত্রী মৃত্যু বরণ করেছেন। আহত ৭জনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। দু’টি গ্যাস সিডিন্ডার উদ্ধার করা হয়েছে। একটি সিলিন্ডার যে জায়গায় প্রায় ২০ ফুট রেললাইন কেটে রাখা হয়েছে তার পাশেই ছিল। অপর সিলিন্ডারটি কিছু দূরে পরিত্যাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে।

তিনি বলেন, ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা দেখে বুঝাই যাচ্ছে, এটা নাশকতামূলক কর্মকান্ড। দুষ্কৃতকারীরা গ্যাস সিলিন্ডার দিয়ে প্রায় ২০ ফুটের মতো লাইন কেটে রেখে দিয়েছিল। যার কারণে মোহনগঞ্জ একপ্রসেরে ৬টি বগি লাইনচ্যুত হয়ে যায়। ইতিমধ্যে আমরা তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। ঘটনার সঙ্গে যারাই জড়িত থাকুক, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। আইনী প্রক্রিয়া শেষে লাশ তার পরিবারের নিকট হস্তান্তর করা হবে।
তিনি আরো বলেন, যারা অবরোধ দেয়েছেন, তারাতো চান না রেল-বাস চলুক। ধারণ করা হচ্ছে যারা চায় না, তাদের উদ্দেশ্যমূলক কর্মকান্ড এটা।

ঢাকা বিভাগীয় রেলওয়ে মহাব্যবস্থাপক কামরুল আহসান বলেন, প্রায় একশ’ স্লিপার এবং তিনশ ফুট রেল লাইন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে কোচ গুলো রেললাইনের পাশে রাখব। পরে রেললাইন মেরামত করে ক্রমান্বয়ে কোচগুলো তুলে আনব। তিনি বলেন, আমাদের ট্রেন চলাচল বন্ধ নেই। ঢাকা থেকে মংমনসিংহ- জামালপুর যেসব ট্রেন যায়, সেগুলো বিকল্প পথে ভৈরব হয়ে চলাচল করছে। তিনি জানান, নিহতের পরিবারকে এক লক্ষ টাকা ক্ষতি পূরণ হিসেবে দেয়া হবে। তিনি বলেন, তিনটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। ঘটনার ধরণ দেখে মনে হচ্ছে এটা নাশকতা।

গাজীপুরের পুলিশ সুপার কাজী  সফিকুল আলম বলেন, এটা দুর্ঘটনা নয়, নাশকতা মূলক কাজ। যারা দুষ্কৃতকারী, যারা অবরোধকে সমর্থন দিচ্ছে- তারা এ ঘটনাটি ঘটিয়েছে। আমি মনে করি দুষ্কৃতকারীরা যে কাজটি করেছে তা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। দেশের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান। আমাদের টিম ও গোয়েন্দারা কাজ করছে। আশাকরি অল্প সময়ের মধ্যেই এদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসব।

তদন্ত কমিটি গঠনঃ 

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার বনখড়িয়ায় মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেন দুর্ঘটনার ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে গাজীপুর জেলা প্রশাসন ও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এরমধ্যে একটি রেলওয়ে মন্ত্রনালয়, রেলওয়ে ঢাকা ডিভিশনের পক্ষ থেকে একটি টেকনিক্যাল তদন্ত কমিটি এবং অপরটি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে করা হয়েছে।

বাংলাদেশ রেলওয়ের ঢাকা বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক সফিকুর রহমান বলেন, প্রাথমিকভাবে আমরা নিশ্চিত হয়েছি ঘটনাটি নাশকতা। তারপরও সঠিক কারণ অনুসন্ধানে বিভাগীয় সংকেত ও টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী সৌমিক শাওন কবিরকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্য বিশিষ্ট একটিসহ দুইটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত কমিটিকে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। কমিটির অপর সদস্যরা হলেন বিভাগীয় পরিবহন প্রকৌশলী, বিভাগীয় যাত্রী প্রকৌশলী, বিভাগীয় চিকিৎসক প্রমুখ।

গাজীপুর জেলা প্রশাসক (ডিসি) আবুল ফাতেহ মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম জানান, গাজীপুরের জেলা প্রশাসন থেকে পাঁচজন সদস্যের গঠিত তদন্ত কমিটিতে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হুমায়ুন কবিরকে প্রধান করা হয়েছে। পাঁচ সদস্যের এ তদন্ত কমিটিকে আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।
 

মন্তব্য ( ০)





  • company_logo